Header Ads

আগামীকাল নতুন সুর্য উঠবে। নতুন দিন শুরু হবে। নতুন একটি পৃথিবীর যাত্রা শুরু হবে। সেই পৃথিবীটা শুধু আল-কোরআনের। এই সপ্ন প্রত্যহই দেখি। শুধু বান্তবায়ন সময়ের অপেক্ষা............

দাজ্জালের বিচরণ ভূমি: খোরাসান থেকে লুদ্দ

নবীজি (সা.) বলেন,

الدَّجَّالُ يَخْرُجُ مِنْ أَرْضٍ بِالْمَشْرِقِ يُقَالُ لَهَا خُرَاسَانُ يَتْبَعُهُ أَقْوَامٌ كَأَنَّ وُجُوهَهُمُ الْمَجَانُّ الْمُطْرَقَةُ ‏"‏

”দাজ্জাল পূর্বাঞ্চলীয় কোন স্থান থেকে বের হবে। স্থানটির নাম হল খোরাসান। কিছু কওম তার অনুসরণ করবে। তাদের চেহারা হবে স্ফীত চ্যাপ্টা ঢালের মতো” [তিরমিজী, আস-সুনান, ২২৪০]।


খোরাসান মধ্য এশিয়ার একটি ঐতিহাসিক অঞ্চল। নবীযুগে বর্তমান উত্তর-পূর্ব ইরান (নিশাপুর, তুশ, মাসহাদ, গুরগান, দামাঘান), উত্তর-পশ্চিম আফগানিস্তান (হেরাত, বালখ, কাবুল, গাজনি, কান্দাহার), দক্ষিণ তুর্কমেনিস্তান (মেরি প্রদেশ-মার্ভ, সানজান), উত্তর-পশ্চিম তাজিকিস্তান (সুগ্ধ প্রদেশের খোজান্দ, পাঞ্জাকেন্ত), উত্তর ও দক্ষিণ-পূর্ব উজবেকিস্তান (সামারকান্দ, বুখারা, সেহরিসাবজ, আমু নদী ও সীর নদীর মধ্যাঞ্চল),  উত্তর-পশ্চিম পাকিস্তান (মালাকান্দ, সোয়াত, দীর, চিত্রাল) ও দক্ষিণ কাজিকিস্তানের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল খুরাসানের অন্তর্ভুক্ত বলে পরিগণিত হত। এই অঞ্চলের উত্তরসীমায় ছিল আমু দরিয়া নদী, পশ্চিমে কাস্পিয়ান সাগর, দক্ষিণে মধ্য ইরানের মরু অঞ্চল ও পূর্বে মধ্য আফগানিস্তানের পার্বত্য উচ্চভূমি।


খুরাসানের একটি প্রসিদ্ধ এলাকা ছিল ‘ইসফাহান’। বর্তমান ইরানের জাগ্রোস পর্বতমালার পাদদেশে জায়েন্দে নদীর তীরে শহরটি অবস্থিত। ভৌগোলিক অবস্থানগত দিক থেকে প্রাচীনকালের ব্যবসায়ী কাফেলার চলাচলের মহাসড়কের মাঝে অবস্থানের কারণে ইসফাহান যেমন আরব-অনারবদের কাছে ব্যাপক পরিচিতি পায়, তেমনি ইউরোপ এবং দূরপ্রাচ্য আকর্ষণীয় বাণিজ্যিক শহর হিসেবে পরিগণিত হয়। নবীজির (সা.) অন্য একটি হাদীসে দাজ্জাল প্রকাশের স্থান খোরাসানের ইসফাহানকে সুর্নিদিষ্ট করেছেন। আইশা (রা.) বলেন, নবীজি (সা.) বলেছেন, ”দাজ্জাল ইসফাহানের ইহুদিয়া থেকে বের হবে [আহমদ, মুসনাদ, ২৪৫১১]।



ইরানের রাজধানী শহর তেহরান থেকে ৩৪০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত দেশটির তৃতীয় বৃহত্তম নগরী ইসফাহান। প্রদেশ হিসেবে তা কেন্দ্রীয় ইরানের এক লক্ষ ছয় হাজার বর্গকিলোমিটার জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। ইসলামী স্থাপত্য, ছাদ ঢাকা সেতু, মসজিদ ও মিনারের অসাধারণ সৌন্দর্য শহরটিকে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করে রেখেছে। ইসফহানের সৌন্দর্য কিংবদন্তিতুল্য। ইরানে প্রবাদ প্রচলিত আছে "ইসফাহান নেস্‌ফে জাহন আস্‌ত" যার অর্থ "ইসফাহান পৃথিবীর অর্ধেক"। 


নবীজির (সা.) হাদীস অনুযায়ী এখানকার ‘ইয়াহুদিয়া’ থেকে দাজ্জাল আত্নপ্রকাশ করবে। ইবন কাসীর (র.) বলেন, তার আবির্ভাবের সূচনা হবে ইসফাহান থেকে; এখাকার একটি এলাকা থেকে যাকে ’আল-ইয়াহুদিয়া’ বলা হয় [আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, পৃ. ৫৯]। 


ইবন আল-ফাকীহ একটি ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছেন যে, ইহুদিরা বখতনসরের ধ্বংসলীলা থেকে পালিয়ে আসার সময় সাথে করে জেরুজালেম থেকে পানি এবং মাটির নমুনা নিয়ে এসেছিল। তারপর প্রতিটি জায়গার পানি এবং মাটি পরীক্ষা করে অগ্রসর হচ্ছিল। কিন্তু কোনো শহরে তারা বসতি স্থাপন করেনি। ইসফাহান শহরের পানি ও মাটি পরীক্ষা করে দেখল উভয়-ই জেরুজালেমের অনুরূপ। তারপরে তারা এখানে বসতি স্থাপন করে। ফলে মহল্লাটির নাম হয় ইয়াহুদিয়া [ইবন আল-ফাকীহ, কিতাবুল বুলদান, পৃ. ২৬১-২৬২]।


ইবন হাজার আসকালানী (র.) ইয়াহুদিয়া সম্পর্কে অনেক তথ্য দিয়েছেন। ব্যবলনের রাজা বখতনসর যখন বাইতুল মাকদিসে আগ্রাসন চালিয়েছিল তখন ইহুদিদের একটি বড় অংশ জেরুজালেম ছেড়ে ইসফাহানে এ ইয়াহুদিয়া অঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছিলো। ফলে ওই এলাকার নাম হয়ে যায় ইয়াহুদিয়া। ইহুদী সম্প্রদায়ের মধ্যে ইসফাহানী ইহুদিদের বিশেষ এক মর্যাদা রয়েছে [ফাতহুল বারী, ৩০/৪৫]। ”আবু নাইম তার ‘তারীখ ইসফাহান’ গ্রন্থে বলেছেন: ‘আল-ইয়াহুদিয়া’ ছিল ইসফাহানের একটি গ্রাম। এটাকে এজন্য ইয়াহুদিয়া বলা হতো যে, তা নির্দিষ্টভাবে শুধুমাত্র ইহুদিদের বসবাসের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। এভাবে আল-মাহদী আল-মানসূরের যুগে মিশরীয় শাসক আইয়্যুব ইবন জিয়াদ মুসলিমদের বসতি নির্মাণের পূর্ব পর্যন্ত এখানে একমাত্র ইহুদি বসতি ছিল। মুসলিমদের বসতি নির্মাণের পর ইহুদিদের জন্য স্বতন্ত্র একটি অংশ অবশিষ্ট রয়ে গিয়েছিল” [ফাতহুল বারী, ১৩/২৭৭]।


ইবন হাজারের মূল্যায়নে নবীজি (সা.) ও সাহাবীদের সময়ে সন্দেহকৃত দাজ্জাল ইবন সাইয়্যাদ একসময় তার বন্ধুদের নিয়ে ইসফাহানে অদৃশ্য হয়েছে [ফাতহুল বারী, ১৩/৩২৮]। ইবন সাইয়্যাদের মূল নাম ‘সাফ’ বা ‘সাফী’ কিংবা ‘আব্দুল্লাহ’। হাদীসে তার নাম ইবন সাইয়্যাদ ও ইবন সায়েদ দু’বানানে এসেছে। দাজ্জালের মাতা-পিতার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে নবীজি (সা.) যা যা বলেছেন, তা ইবন সাইয়্যাদের ক্ষেত্রে হুবহু মিলে গিয়েছিলো [তিরমিজী, আল-জামি, ২২৫১]। নবীজি (সা.) তার দাজ্জাল হওয়া সম্পর্কে কিছুটা সন্দেহে পড়ে গিয়েছিলেন [বুখারী, আস-সহীহ, ২৫২৯]। ওমর (রা.) বারবার নবীজির (সা.) সম্মুখে ইবন সাইয়্যাদের দাজ্জাল হওয়ার ব্যাপারে কসম করলে নবীজি (সা.) তা অস্বীকার করেননি [আবূ দাউদ, আস-সুনান, ৪৩৩১] এবং তবে নবীজি (সা.) তাকে হত্যার অসম্ভবতা তুলে ধরেছিলেন [আবূ দাউদ, আস-সুনান, ৪২৭৮]। সাহাবীদের অনেকের বিশ্বাস ছিলো ইবন সাইয়্যাদ দাজ্জাল। ইবন ওমর (রা.) দৃঢ়তার সাথে বিশ্বাস করতেন যে ইবন সাইয়্যাদ-ই অনাগত দাজ্জাল [আবূ দাউদ, আস-সুনান, ৪৩৩০]। তিনি তার মাঝে ক্রমাগত পরিবর্তনের মাঝে চোখ স্ফীত হয়ে উঠা লক্ষ্য করেছিলেন [মুসলিম, আস-সহীহ, ৭০৯৩]। ইবন সাইয়্যাদের  সর্বশেষ পরিণতি সম্পর্কে সাহাবীদের বক্তব্য হচ্ছে,  ”হাররার ঘটনার দিন (ইয়াযীদের সৈন্যদল যেদিন মদীনায় প্রবেশ করে) ইবন সাইয়্যাদ আমাদের কাছ থেকে হারিয়ে গেছে” [আবূ দাউদ, আস-সুনান, ৪২৮১]।


ইবন হাজার (র.) মুসলিম বাহিনীর ইসফাহান বিজয়ের সময় ইয়াহুদিয়ার একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন। আব্দুর রহমান (র.) বলেন, যখন আমরা ইসফাহান বিজয় করি তখন আমাদের সেনাকেন্দ্র এবং ইয়াহুদিয়া এলাকার মাঝে এক ফারসাখ (৫.৮ কি.মি.) পরিমাণ দূরত্ব ছিলো। আমরা নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী ক্রয়ের জন্য প্রায়ই ইয়াহুদিয়া এলাকায় যাতায়াত করতাম। একদিন আমি সেখানে গিয়ে দেখি, ইহুদিরা তবলা বাজিয়ে নেচে গেয়ে উৎসব পালন করছে। ওখানে আমার পরিচিত এক ইহুদি ছিলো। তাকে গিয়ে উৎসব পালনের কারণ জিজ্ঞেস করলে সে বলে, আজ আমাদের মুক্তিদাতা মহান সম্রাটের আগমন হবে, যার নেতৃত্বে আমরা পুনরায় আরবদের উপর বিজয় অর্জন করবো। তার উত্তর শুনে আমি সে রাত্রটি পাশের পাহাড়ের উঁচু একটি টিলার উপরে কাটালাম। যখন ভোর হয়ে সূর্যোদয় হলো তখন আমাদের সেনাকেন্দ্রের দিক থেকে ধুলাবালি উড়তে দেখা গেলো। আমি দেখি, এক ব্যক্তি এগিয়ে আসছে, যার পরনে রাইহান সুগন্ধিযুক্ত পোশাক ছিলো। ইহুদীরা তখন আরো বেশি নাচছিলো। কিছুটা নিকটে আসার পর যখন আমি লোকটাকে ভালো করে প্রত্যক্ষ করলাম তখন দেখি সে হলো ইবন সাইয়্যাদ। এরপর সে ইয়াহুদিয়া এলাকায় প্রবেশ করে। এখন পর্যন্ত সে ওখান থেকে ফিরে আসেনি [ফাতহুল বারী ৩০/৪৩, তারিখে ইসফাহান ১/১৪]।


পুরনো ইয়াহুদিয়ার বর্তমান নাম 'জোবরেহ' যা তার অনন্য বৈশিষ্ট্যের কারণে ইসফাহানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ও পর্যটন কেন্দ্র। এটা ইসফাহানের মূল এলাকা যা অ্যাকেনেমিড শাসনকালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত শহরটি ‘দারুল ইয়াহুদ’ নামে পরিচিত ছিল। পরে একসময় তার নাম হয় 'জাহানবারেহ' এবং পরবর্তীতে 'জোবরেহ'। মহল্লা জোবরেহ ইসফাহানের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত, যা উত্তরে কুদস স্কয়ার, দক্ষিণে আবদুর-রাজাক স্কয়ার, পশ্চিমে হাতেফ স্ট্রিট এবং আতিক স্কয়ার, পূর্বে সুরুশ স্ট্রিট পর্যন্ত বিস্তৃত। এটা ইসফাহানের প্রধান ইহুদি এলাকা, অতীতে যা ঘনবসতি ছিল। ইরানে ইহুদীদের ধর্মীয় উপাসনা এবং উপাসনালয় প্রতিষ্ঠা আইন স্বীকৃত। ফলে সেখানকার খুব কম সংখ্যক ইহুদি ইসরাইলে ফিরে যায়। এখানকার ইহুদিরা রাজধানী তেহরান, সিরাজ, কুম, মরু ইত্যাদি এলাকায় স্থানান্তরিত হয়েছে এবং বিভিন্ন সিনাগগ প্রতিষ্ঠা করেছে। তেহরানে বত্রিশটি, সিরাজে আঠারোটি, ইসফাহানে ছাব্বিশটি, ইয়াজদে নয়টি, হামাদানে আটটি এবং বিভিন্ন প্রদেশ ও জেলা শহরে ছড়িয়ে আছে আরো অনেক সিনাগগ। ইসফাহানের ‘জোবরেহ' ও 'মোল্লা জেকব সিনাগগ' ইহুদিদের নিকট গুরুত্বপূর্ণ সিনাগগ হিসেবে মর্যাদা পেয়ে থাকে। ইরানের জনপরিসংখ্যান অনুযায়ী ইসফাহানে বসবাসরত ইহুদীদের সংখ্যা বর্তমানে ত্রিশ হাজার। তবে দেশটিতে ইহুদী জনসংখ্যা আরো অনেক। হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী ইসফাহানের সত্তর হাজার ইহুদী দাজ্জালের সাথে যোগ দিবে যাদের শরীরে কালো চাদরাবৃত থাকবে [মুসলিম, আস-সহীহ,  ৭১২৫]। হাদীসের ভাষ্য দ্বারা অনুমেয় এসকল ইহুদি রাব্বি প্রকৃতির হবে এবং তারা বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দাজ্জালের সাথে একত্রিত হবে। 


ইসফাহানের অন্তর্গত ইরানের উত্তর-পূর্ব সীমান্তবর্তী শহর 'মারূ'। ঐতিহাসিক 'মারূ' ইরান ও তাজিকিস্তান সীমান্তবর্তী অঞ্চল। তাজিকিস্তানের অংশের বর্তমান নাম 'মারি'। নাঈম ইবন হাম্মাদের (র.) বর্ণনা অনুযায়ী দাজ্জাল মারূর ইহুদীদের থেকে বের হবে [নাঈম ইবন হাম্মাদ, কিতাবুল ফিতান, ১৪৯৫]। তার সংকলিত আরেকটি হাদীস অনুযায়ী দাজ্জালের বের হওয়ার সাথে একটি সাগর উপকূলীয় অঞ্চল সংশ্লিষ্ট [নাঈম ইবন হাম্মাদ, আল-ফিতান, ১৪৯৩]। আল-কাযবিনী (র.) ইরানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় কাস্পিয়ান সাগরের তীরবর্তী উপকূলে ‘কেলেস্তান’ পাহাড়কে এমনটি একটি এলাকা হিসেবে সনাক্ত করেছেন। যেমনটা তিনি লিখেছেন:


”খোরাসান একটি প্রসিদ্ধ ভূমি; পূর্বে ট্রানসক্সিয়ানা এবং পশ্চিমে কাহিস্তান; তার প্রধান শহরগুলো মারূ, হেরাত, বালখ এবং নিশাপুর। এটি আল্লাহর সৃষ্ট পৃথিবীর অপরূপ সৌদর্য্যময় , জনবহুল এবং অত্যধিক কল্যাণকর ভূমি। তার অধিবাসীরা রূপের অনুপম, বুদ্ধিতে নিখুঁত, স্বভাব-প্রকৃতিতে ন্যায়শ্রেষ্ঠ এবং ধর্ম ও জ্ঞানে অগ্রগামী। সেখানে ‘কেলেস্তান’ নামক একটি পাহাড় রয়েছে; খোরাসানের কোনো কোনো ফকীহ আমাকে বলেছেন যে, এই পাহাড়ে একটি গুহা আছে যা খিলান সদৃশ এবং তাতে রয়েছে একটি প্রাসাদ যাতে রয়েছে গলি সদৃশ পথ; একজন ব্যক্তি ঝুঁকে বাঁক নিয়ে অগ্রসর হতে পারে; তারপর ট্যানেলের শেষে কিছু আলো মিলে। দেখতে এটি যেনো পরিবেষ্টিত গোলাবাড়ি সদৃশ, তাতে রয়েছে একটি ঝর্ণা যা থেকে পানি প্রসবণ হয়; সে ঝর্ণার উপরে রয়েছে একটি পাথর যা লোহা সদৃশ। আর সে গোলাবাড়িতে রয়েছে একটি  গহবর যা দিয়ে প্রচণ্ড বায়ু নিসরিত হয়; প্রবল ঝঞ্চায় কারো পক্ষে সেখানে প্রবেশ দুঃসাধ্য” [যাকারিয়া ইবন মুহাম্মদ আল-কাযবিনী, আসারুল বিলাদ ওয়া আখবারুল ইবাদ, পৃ. ৩৬১-৩৬২]।


দাজ্জালের অবস্থান সম্পর্কিত সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক সাহাবী তামিম আদ-দারীর ঘটনা যা নবীজি (সা.) সাহাবীদের বর্ণনা করে শুনিয়েছিলেন, সেখানে নবীজি (সা.) বলেন, “সাবধান! সে সিরিয়া সাগরে বা ইয়ামান সাগরে রয়েছে; না, বরং সে পূর্বদিকে রয়েছে, সে পূর্বদিকে রয়েছে, সে পূর্বদিকে রয়েছে। এসময় তিনি তার হাত দ্বারা পূর্ব দিকে ইশারাও করলেন” [মুসলিম, আস-সহীহ, ৭১১৯]। এ হাদীসে দাজ্জাল ছাড়াও ’জাসসাসাহ’ নামক একটি অদ্ভূদ প্রাণীর কথা বলা হয়েছে যে সে দ্বীপে দাজ্জালের জন্য গোপন সংবাদ সংগ্রহ করে। আল-কাযবিনী ‘জাজিরাতুল জাসসাসাহ’ বলতে ‘কাস্পিয়ান সাগরের দ্বীপ বুঝিয়েছেন [আল-কাযবিনী, আসরারুল বিলাদ, ১৭৮]।


দাজ্জাল জাবালু কেলেস্তান থেকে মুক্তি পেয়ে ইসফাহানের মারূ হয়ে ইয়াহুদিয়া প্রবেশ করবে। আইশা (রা.) বলছেন যে, ইয়াহুদিয়া থেকে তার গন্তব্য হবে মদীনা [আহমদ, মুসনাদ, ২৩৯৪]। তবে মদীনায় আসার পথে খুজিস্তান ও কিরমানে অবতীর্ণ হবে। আবূ হুরাইরা (রা.) বলেন, নবীজিকে (সা.) আমি বলতে শুনেছি যে, অবশ্য-ই দাজ্জাল সত্তর হাজার স্ফীত চ্যাপ্টা ঢালের মত চেহারার লোক নিয়ে ‘খুজ’ ও ’কিরমানে’ অবতীর্ণ হবে [আহমদ, মুসনাদ, ৮২৪৮]। তারপর সে দজলার পাড়ে কুসায় আসতে পারে। মুয়াবিয়ার (রা.) সামনে উপস্থিত আব্দুল্লাহ ইবন আমরকে তিনি বলেছিলেন, “তুমি কি ‘কুসা’ নামক একটি এলাকা চেনো যা খুব লবণাক্ত ভূমি? সে বললো হ্যাঁ! তিনি বললেন, সেখান থেকে দাজ্জাল বের হবে [নাঈম ইবন হাম্মাদ, আল-ফিতান, ১৫০৪]। কুসার বর্তমান নাম ‘তাল্ল ইবরাহীম যা দজলা নদীর পাড়ে অবস্থিত [জি. লে স্ট্রেঞ্জজ, বুলদান আল-খিলাফাহ আশ-শারকিয়্যাহ, পৃ. ৯৫-৯৬]। স্থানটিকে নবী ইবরাহীমের (আ.) জন্মস্থান মনে করা হয়। একটি হাদীসে দাজ্জাল বের হওয়ার স্থান হিসেবে ‘ইরাক ও শামের মধ্যবর্তী ‘খুল্লা’ নামক স্থানের উল্লেখ রয়েছে, "নিশ্চয় সে (দাজ্জাল) সিরিয়া ও ইরাকের মধ্যবর্তী 'খাল্লা' নামক স্থান থেকে বের হবে। অতঃপর ডানে-বামে সর্বত্র বিপর্যয় সৃষ্টি করবে” [ইবন মাজাহ, আস-সুনান, ৪০৭৭]। খুল্লা মূলত দাজ্জালের জাজিরাতুল আরবে প্রবেশের পথ যা উভয় শহরের মধ্যবর্তী কোন স্থান। কাযী আয়াজ অবশ্য ‘খুল্লা’ শব্দটিকে ‘হুল্লা’ মনে করেন যা দজলার পাড়ে অবস্থিত একটি গ্রাম। 


আরব ভূমিতে প্রবেশের পূর্বে ডানে-বামে বিপর্যয়ের কথা বলা হয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা.) মনে করতেন, দাজ্জাল কর্তৃক কুফা আক্রান্ত হবে। তিনি বলেন, “নিশ্চয়-ই আমি দাজ্জাল কর্তৃক তোমাদের সর্বপ্রথম আক্রান্ত গৃহগুলোর অধিবাসীদের সম্পর্কে আমি অবহিত, হে কূফাবাসী! [ইবন আবি শাইবা, আল-মুসান্নাফ, ৩৮৬৯৪]। কাব (রা.) বর্ণনা মতে, দাজ্জাল গুরুত্বপূর্ণ শহর বসরাতেও অবতীর্ণ হবে। তিনি বলেন, “সর্বপ্রথম দাজ্জাল যে পানিতে অবতীর্ণ হবে তা হলো বসরার উচু পাহাড়ের পাদদেশের পানি। সেখানে অনেক বালি মিশ্রিত পানি রয়েছে, তাতে দাজ্জাল সর্বপ্রথম অবতীর্ণ হবে” [নাঈম ইবন হাম্মাদ, আল-ফিতান, ১৫০৭]। হাদীস সমূহে বিধৃত একাধিক স্থানে দাজ্জালের আত্নপ্রকাশের বর্ণনা মানচিত্রের দিকে তাকিয়ে গভীরভাবে পাঠ করলে পরিস্কার বুঝা যায় যে, এসকল স্থান সব-ই পূর্বদিকে অবস্থিত। হতে পারে কোন এক স্থানে দাজ্জাল প্রকাশের পর আবার অদৃশ্য হয়ে আরেক স্থানে প্রকাশিত হবে, হতে পারে একেবারে পূর্বদিক থেকে প্রকাশিত হয়ে একেকটি স্থান অতিক্রম করে ক্রমাগত আরব ভূমিতে প্রবেশ করবে। 


দাজ্জালের একমাত্র গন্তব্য মদীনা হলেও সে তাতে প্রবেশ করতে পারবে না [বুখারী, আস-সহীহ, ৬৬৪৮]। তবে সে মদীনার বাহিরে জুরুফের এক অনুর্বর লবণাক্ত ভূমিতে অবতরণ করবে এবং এখানেই সে তার শিবির স্থাপন করবে [মুসলিম, আস-সহীহ, ৭১২৪]। আবূ হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত যে, নবীজি (সা.) বলেছেন, মাসীহ দাজ্জাল মদীনা আক্রমণের উদ্দেশে এসে উহুদ পাহাড়ের পশ্চাতে অবতরণ করবে এবং ফেরেশতাগণ তার মুখ (গতি) সিরিয়ার দিকে ফিরিয়ে দিবে আর তথায় সে ধ্বংস হবে” [মুসলিম, আস-সহীহ, ৩২১৭]। ফলে মদীনা থেকে সে সিরিয়ার অভিমুখে অগ্রসর হবে। মানুষেরা তার ভয়ে পাহাড়ে পালিয়ে যাবে [মুসলিম, আস-সহীহ, ৭১২৬]।


দাজ্জাল পূর্ব দামিস্কের যে মসজিদে নবী ঈসা (আ.) অবতীর্ণ [ইবন মাজাহ, আস-সুনান, ৪০৭৫] তার বাহিরে অনতিদূরে অবস্থান নেয়ার কথা হাদীসের বর্ণনা থেকে প্রতিয়মান হয়। এখানে নবী ঈসাকে (আ.) দেখামাত্র সে পানিতে লবণ বিগলিত হওয়ার ন্যায় বিগলিত হতে থাকবে এবং ভেগে পলায়ণ করতে থাকবে [ইবন মাজাহ, আস-সুনান, ৪০৭৭]।  তারপর সিরিয়ার ‘আকাবা আফীক’ নামক স্থানে তার ধ্বংস হওয়ার কথা হাদীসে বিধৃত হয়েছে [আহমদ, মুসনাদ, ২১৪২২]। ‘আকাবা আফীক’ বর্তমানে জর্ডানের হাওরানের গ্রামগুলোর একটি। বর্তমানে তাকে ‘ফীক’ নামে ডাকা হয় যা আল-গাওরের পথে প্রথম আকাবা নিকট অবস্থিত। তার দৈর্ঘ্য প্রায় দু’মাইল [ইয়াকূত আল-হামাভী, মুজামুল বুলদান, ১/২৩৩]। নবী ঈসার (আ.) ভয়ে দাজ্জাল পালিয়ে ‘লুদ্দ’ নামক শহরে আশ্রয় নিবে। নবী ঈসা (আ.) তাকে হত্যার জন্য খোঁজ করবেন এবং 'লুদ্দের নগরদ্বারে পেয়ে হত্যা করবেন [তিরমিজী, আস-সুনান, ২২৪০]। লুদ্দ বর্তমান ইসরাইল অধিকৃত ঐতিহাসিক ফিলিস্তিন ভূখন্ডের একটি ছোট শহর, যা তেলআবিব থেকে ১৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। ইসরাইলের প্রধানতম বিমানবন্দর বেন গুরিয়ান বিমানবন্দর এ শহরটির নিকটেই অবস্থিত। ইসরাইলের তেলআবিব থেকে ১৮ কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্বে অবস্হিত।


সাধারণভাবে দাজ্জাল পৃথিবীর সকল শহরে প্রবেশ করবে বলে বর্ণিত আছে। আনাস (রা.) হতে বর্ণিত, নবীজি (সা.) বলেন, ”মক্কা ও মদিনা ব্যতীত এমন কোন শহর নেই যেখানে দাজ্জাল অনুপ্রবেশ করবে না” [বুখারী, আস-সহীহ, ১৭৬১]। সাহাবী তামীম আদ-দারীর ঘটনায় দাজ্জালের কথা উদ্ধৃত হয়েছে, “অচিরেই আমাকে ভূপৃষ্ঠে আত্মপ্রকাশ করার অনুমতি প্রদান করা হবে। আমি আত্মপ্রকাশ করবো। বিশ্বজুড়ে বিচরণ করবো। পৃথিবীর এমন কোনো শহর নগর থাকবে না যেখানে আমি প্রবেশ করবো না। চল্লিশ রজনি আমি এভাবে বিশ্বব্যাপী ঘুরে বেড়াবো [মুসলিম, আস-সহীহ, ৭১১৯]।  অন্য একটি হাদীসে এসেছে, নবীজি (সা.) বলেছেন, “তার আধিপত্য প্রতিটি ঘাটে ঘাটে পৌঁছে যাবে।  চারটি মসজিদে সে আসতে পারবে না; মসজিদুল হারাম (পবিত্র মক্কা), মসজিদু নববি (পবিত্র মদিনা), মসজিদু তূর (তূর পাহাড়) ও মসজিদুল আকসা (পবিত্র আল-কুদস)” [আহমদ, মুসনাদ, ২৩১৩৯]। অন্য একটি হাদীসে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চই পথভ্রষ্ঠ কানা মাসিহ দাজ্জাল পূর্বদিক থেকে বের হবে এমন এক সময় যখন মানুষজনের মাঝে বিরোধ ও দলাদলি প্রকট মাত্রায় থাকবে। সে পৃথিবীতে আল্লাহ যতটুকু চাইবেন ততটুকুতে চল্লিশ দিনে পৌঁছে যাবে। ‘ আল্লাহ-ই ভালো জানেন যে, তার (চল্লিশ দিনের) পরিমাণটা কতো! আল্লাহ-ই ভালো জানেন যে, তার পরিমাণটা কতো! একথা দু'বার বললেন’ [ইবন হিব্বান, আস-সহীহ, ১৫/২২৩]।


হাদীসের আলোকে দাজ্জালের বিচরণ ক্ষেত্র আলোচিত হলো। হাদীসে দাজ্জাল অবতীর্ণ হওয়ার যে সকল শহরের নাম এসেছে, তার অর্থ এ নয় যে, এটা একটি মন্দ স্থান। আল্লাহ তাআলা আখিরুয-যমানের ফিতনা থেকে আমাদের রক্ষা করুন। আমীন।

No comments

Powered by Blogger.