Header Ads

আগামীকাল নতুন সুর্য উঠবে। নতুন দিন শুরু হবে। নতুন একটি পৃথিবীর যাত্রা শুরু হবে। সেই পৃথিবীটা শুধু আল-কোরআনের। এই সপ্ন প্রত্যহই দেখি। শুধু বান্তবায়ন সময়ের অপেক্ষা............

যূল-কারনাইনের নগরী আলেকজান্দ্রিয়া

আলেকজান্দ্রিয়া 


আল্লাহ তাআলা বলেন, 

وَيَسْأَلُونَكَ عَنْ ذِي الْقَرْنَيْنِ قُلْ سَأَتْلُو عَلَيْكُمْ مِنْهُ ذِكْرًا * إِنَّا مَكَّنَّا لَهُ فِي الْأَرْضِ وَآتَيْنَاهُ مِنْ كُلِّ شَيْءٍ سَبَبًا *

“আর তারা আপনাকে যুল-কারনাইন সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করে। বলুন, অচিরেই আমি তোমাদের কাছে তার বিষয় বর্ণনা করব। আমি তাকে যমীনে কর্তৃত্ব দান করেছিলাম এবং প্রত্যেক বিষয়ের উপায়-উপকরণ দিয়েছিলাম। [আল-কাহাফ:৮৩-৮৪]।


উদ্ধৃত আয়াতে যূল-কারনাইন শাসিত অঞ্চলকে ‘আল-আরদ’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যূল-কারনাইনের শাসন ছিলো পৃথিবীর একটি বিশাল অংশ নিয়ে। সূরা কাহাফের পরবর্তী আয়াতগুলোতে [৮৫-৯৭] তাঁর পূর্ব-পশ্চিম ও উত্তরের দিকে পরিভ্রমণের যে তিনটি  সীমান্ত বর্ণিত হয়েছে, সেখানে যদি পশ্চিম সীমান্ত কৃষ্ণ সাগর, পূর্ব সীমান্ত কাস্পিয়ান এবং উত্তর সীমান্ত ককেশাসের পাহাড় অর্থ নেয়া হয়, তাতেও প্রতিয়মান হয় যে তিনি পৃথিবীর একটি বিস্তৃত অংশের শাসক ছিলেন। ভৌগলিক বৈশিষ্ট্যের কারণে পশ্চিমের সফরে কৃষ্ণ সাগর যেমন সূর্য্যের একটি অস্তাচল, তেমনি কাস্পিয়ানের তীর যেনো সূর্য্যের একটি অরুণাচল। এ তিন সীমান্ত নির্ধারণ সম্পর্কে ”ইয়াজূজ-মাজূজের ভূমি: পবিত্র কুরআন-হাদীসের তথ্য বিশ্লেষণ” শিরোণামে পরবর্তীতে আলোচনা করবো। উল্লেখিত তিনটি পরিভ্রমণ সীমান্তকে যূল-কারনাইন রাজ্যের প্রান্ত সীমা বলা যায় না; বরং রাজ্যের অনুল্লেখিত দক্ষিণ সীমান্ত এবং তা হয়ে ক্রমাগত এশিয়ার পশ্চিমাঞ্চল ও পূর্ব আফ্রিকা যূল-কারনাইন রাজ্যভূক্ত হওয়ার সম্ভাবনা কুরআন নাকচ করে না। 


কুরআন-হাদীস ও ইসলামী সাহিত্যে মিসরীয় নগরী আলেকজান্দ্রিয়ার আরবী নাম ‘আল-ইস্কান্দারিয়া। মিসরের আলেকজান্দ্রিয়া নগরী যুল-কারনাইনের রাজ্যভূক্ত হতে পারে; বরং প্রধানতম শহরও হতে পারে। নবীজির (সা.) একটি হাদীসের দিকে আমরা দৃষ্টি দিতে পারি।


“উকবা ইবন আমির আল-জুহানী (রা.) বলেন, আমি নবীজির (সা.) খেদমত করতাম। একদিন আমি বের হয়েছি, এমন সময় আহলু কিতাবের কিছু লোক কিতাবাদী নিয়ে নবীজির (সা.) গৃহের দরজায় উপস্থিত। তারা বললো, কে আমাদের জন্য নবীজির (সা.) কাছে অনুমতি প্রার্থনা করবে? তারপর আমি নবীজির (সা.) নিকট আসলাম এবং তাঁকে অবহিত করলাম। তিনি বললেন, আমার এবং তাদের মাঝে এমন কি! তারা আমাকে এমন বিষয়ে প্রশ্ন করে, যা আমি অবহিত নই; আমি এমন একজন বান্দা মাত্র, যাকে আমার প্রভূ যতটুকু জানান, কেবল ততটুকু আমি অবহিত। তারপর তিনি বললেন, আমাকে ওযূর পানি দাও। আমি ওযূর পানি নিয়ে আসলে তিনি ওযূ করেন এবং মসজিদের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলেন। তারপর তিনি দু’রাকাত সালাত আদায় করেন এবং ফিরে আসেন। আমি তাঁর চেহারায় আনন্দের হিল্লোল এবং শুভচিহ্ন দেখতে পেলাম। তারপর আমাকে বললেন, কাফেলাকে প্রবেশ করাও এবং উপস্থিত আমার সাহাবীদেরকেও প্রবেশ করতে বলো। আমি তাদেরকে অনুমতি দিলে তারা প্রবেশ করলো।  নবীজি (সা.) তাদেরকে বললেন, “যদি তোমরা চাও, তোমাদের কথা বলার পূর্বে-ই আমি তা তোমাদেরকে বলবো, যা তোমরা প্রশ্ন করার ইচ্ছা করেছো। আর তোমরা চাইলে বলতে পারো, তারপর আমি বলছি!” তারা বললো, বরং আপনি-ই বলুন! আমাদের বলবার আগে। তিনি বললেন, ‘তোমরা এসেছো, আমাকে যূল-কারনাইন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবে। আমি তোমাদেরকে তাঁর সম্পর্কে বলছি, ঠিক যেভাবে তা তোমাদের নিকট লিপিবদ্ধ পাবে; তাঁর ব্যাপারে প্রথম কথা হচ্ছে যে, সে একজন রোমান গোলাম যাকে রাজ্য দেয়া হয়েছে। তারপর সে মিসরীয় ভূমিতে সমুদ্র উপকূল পরিভ্রমণ করেন। অতপর সেখানে একটি শহরের গোড়াপত্তন করেন যাকে ‘আল-ইস্কান্দারিয়া’ অভিহিত করা হয়। যখন তিনি শহর নির্মাণ সম্পন্ন করেন, তখন একজন ফেরেশতা আসলো এবং তাকে উর্ধ্বে আরোহন করলো ও উপরে তুলে ধরলো। তাকে বললো, ‘তোমার নিচে যা আছে তা দেখো’। তিনি বললেন, ‘দু’টি শহর’। তারপর তাঁকে আরো উত্তোলিত করা হলো। ফেরেশতা বললো, দেখো। তারপর তিনি বললেন, ‘কিছু-ই দেখছি’। তারপর তাঁকে বলা হলো, ঐ দুই শহরের একটি আসলে ভূমধ্য সাগর। তারপর দীর্ঘ হাদীসের পর নবীজি (সা.) এ আয়াতটি পড়লেন, “আমি তাকে প্রত্যেক বিষয়ের উপায়-উপকরণ দিয়েছিলাম। অতঃপর সে এক পথ অবলম্বন করলো [আল-কাহাফ:৮৪-৮৫]। তারপর তারা বললো, আমরা কিতাবে অনুরূপ-ই পেয়েছি [বাইহাকী, দালাইলু আন-নাবুওয়াহ, ২৫৫৯]।



নবীজির (সা.) এ বর্ণনা আলেকজান্দ্রিয়ার গোড়াপত্তনের ইতিহাস তুলে ধরছে। কিছু রিওয়ায়াতে আরো পুরনো তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে। এখানে সাহাবী আমর ইবন আল-আসের (রা.) অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ একটি রিওয়ায়াত উপস্থাপন করছি যা শহরটিতে নবীদের পদধুলির প্রমাণ পাওয়া যায়।


আবদুল্লাহ ইবন আমর ইবন আল-আস (রা.) বলেন, আলেকজান্দ্রিয়া সম্পর্কে প্রথম কথা হচ্ছে, ফারাওরা সেখানে বিশ্রামাগার ও বিলাসাশ্রম স্থাপন করেছিলো। এটা হচ্ছে তার প্রথম ভিত্তি স্থাপন এবং নির্মাণ। তারপর   এ ভিত্তি ও নির্মাণের উপর-ই তা অটুট ছিলো। ইতোমধ্যে মিসরে বিভিন্ন শাসকের অদল-বদল হয়েছে। তারপর দালুকা বিনত যুবা আলেকজান্দ্রিয়া এবং বুকাইরের মিনার তৈরি করেন। তারপর যখন সুলাইমান ইবন দাউদ (আ.)  তা জয় করেন, তখন তিনি স্থানটিকে বৈঠকখানা হিসেবে গ্রহণ করেন এবং এখানে একটি মাসজিদ স্থাপন করেন। তারপর যুল-কারনাইন এ ভূমির আধিপত্য লাভ করেন।  তিনি ফারাও এবং অন্য শাসকদের স্থাপত্য ধ্বংস করে দেন, কিন্তু সুলাইমানের নির্মিত স্থাপত্য ধ্বংস করেননি; বরং তাতে ক্ষতিগ্রস্ত অংশে মেরামত করেন। তিনি মিনারকে তার অবস্থার উপর স্থিত রাখেন। তিনি নবরূপে এমনভাবে ইস্কান্দারিয়ার স্থাপনা নির্মাণ করেন যেনো একটি আরেকটির সাদৃশ্যময়। তারপর সেখানে অনেক রোমান ও অন্যান্য শাসকের অদল-বদল ঘটেছে। এমন কোনো শাসক নেই, যিনি নামের সাথে সম্বন্ধ থাকবে এবং পরিচিতি এনে দিবে সে লক্ষ্যে সেখানে নূন্যতম একটি স্থাপনা নির্মাণ করেনি [ইবন আব্দিল হিকাম, ফুতুহু মিসর, পৃ. ৪০]।


কেউ কেউ বলে থাকেন, ইস্কান্দারিয়ার নির্মাতা শাদ্দাদ ইবন আদ। সেখানে একটি শিলালিপি পাওয়া গিয়েছিলো, যাতে লেখা ছিলো “আমি শাদ্দাদ ইবন আদ, যে স্তম্ভ (ইরাম শহর) নির্মাণ করেছে; অনেক সেনাদল প্রস্তুত করেছে; বাহুবলে অনেক রণাঙ্গন স্তিমিত করে দিয়েছে; শহরটিকে নির্মাণ করেছি যেনো সেখানে কোনো বার্ধক্য নেই, কোনো মৃত্যু নেই। এটা সম্ভব হয়েছে যেহেতু পাথর আমার নিকট মাটির মতো কোমল” [ফুতুহুল মিসর, পৃ. ৪০-৪১]। বর্ণিত আছে যে, এখানে আরো একটি শিলালিপি পাওয়া গিয়েছিলো যাতে এসব কথার সাথে অতিরিক্ত আরো লেখা ছিলো “আমি সমুদ্রের মাঝে বারো হাত সমান একটি ভাণ্ডার গচ্ছিত রেখেছি যা উম্মাহ মুহাম্মদ (সা.) ছাড়া আর কেউ উদ্ধার করতে পারবে না” [ফুতুহু মিসর, পৃ. ৭]। পবিত্র কুরআনে আদ জাতির জনপদ হিসেবে উল্লেখিত স্তম্ভের নগরী ‘ইরাম’ জাজিরাতুল আরবের বিস্তীর্ণ রাবউল খালী এলাকায় অবস্থিত। তবে কোনো তাফসীরকার ‘আল-ইস্কান্দারিয়া’ নগরীকে ইরাম শহর হিসেবে উল্লেখ করেছেন [তাবারী, ২৪/৩৬১]।  


তাবিঈ মুজাহিদ (র.) বলেন, আল্লাহ নবী মূসা ও হারূনকে (আ.) বনূ ইসরাঈলের জন্য নিজেদের গৃহকে ইবাদতের উপযুক্ত করে নিমার্ণ করতে আদেশ “তোমরা উভয়ে তোমাদের সম্প্রদায়ের জন্য মিসরে গৃহ নির্মাণ কর” আয়াতটিতে উল্লেখিত মিসর শব্দটি দ্বারা ‘আল-ইস্কান্দারিয়া’ উদ্দেশ্য [তাফসীরু মুজাহিদ, ৬০২]।


কারো মতে, নবী ঈসা ও মাতা মারয়ামকে (আ.) আশ্রয় দান সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে “আর আমরা মারইয়াম-পুত্র ও তার জননীকে করেছিলাম এক নিদর্শন এবং তাদেরকে আশ্রয় দিয়েছিলাম এক অবস্থানযোগ্য ও প্রস্রবণবিশিষ্ট উচ্চ ভূমিতে” বলে যে ভূমির উল্লেখ করেছেন, তা ইস্কান্দারিয়া [আলূসী, রুহুল মাআনী, ১৮/৩৮]।


ইস্কান্দারিয়া ছিলো পরস্পর লেগে থাকা তিনটি শহরের সমষ্টি। একটি মানা শহর, যা মিনার ও তার পাশবর্তী এলাকা; দ্বিতীয়টি নাকীতা বা লাকীতা; আর তৃতীয়টি মূল ইস্কান্দারিয়া, যা বর্তমানে ‘আলেকজান্দ্রিয়া’ নামে বিখ্যাত। প্রত্যেকটি শহরের একেকটি প্রাচীর ছিলো এবং ঐ তিন শহরকে ঘিরে চারদিকে ছিলো আরো কিছু শহর [ফতুহু মিসর, পৃ. ৪২]।


ইবন আব্দিল হিকাম ৮৭১ খৃষ্টাব্দে ইস্কান্দারিয়া পরিভ্রমণ করেছিলেন। তিনি  ইস্কান্দারিয়ায় পাঁচটি মাসজিদের কথা উল্লেখ করেছেন; মিনারের কাছাকাছি স্থানে মাসজিদু মূসা (আ.), মাসজিদুল খিদর, মাসজিদু সুলাইমান (আ.), মাসজিদু যিল-কারনাইন, মাসজিদু আমর ইবন আল-আস (রা.) [ফুতুহু মিসর, পৃ.৪৮।  আল-মাসউদী ইস্কান্দারিয়া ভ্রমণ করেছেন ৯৪৪ খৃষ্টাব্দে। তিনি সেখানে যুল-কারনাইনের কবরের চিহ্ন দেখেছেন মর্মে উল্লেখ করেছেন। ষোড়শ শতকে লিয়ুন আফ্রিকী এখানে এসেছিলেন এবং শহরে প্রবেশের একমাত্র সড়কের পাশে যুল-কারনাইনের কবর প্রত্যক্ষ করেছিলেন। 


যুল-কারনাইনের কবরের পাশ্ববর্তী মাসজিদটির নাম ছিল ‘জামি আল-ইস্কান্দার’ যা এখন ‘জামি দানিয়েল’ নামে প্রসিদ্ধ। অনেকের ধারণা মাসজিদটি নবী দানিয়েলের নামের সাথে সম্পৃক্ত। বনূ ইসরাঈলের নবী দানিয়েলের জন্ম জীবন-যাপন ও মৃত্যু সবকিছু তৎকালীন বাবিল নগরে ঘটেছে। তিনি মিসরে আগমণের ছিটে-ফোটা কোনো তথ্য নেই। বস্তুত আষ্টাদশ শতকের শাফিঈ আলিম শাইখ ‍মুহাম্মদ দানিয়েল আল-মুসিলী এ মসজিদে উসূল ও ইলমু ফারাইদ শিক্ষা দিতেন। ৮১০ হিজরীতে তার ইন্তিকালের পর এখানে তাকে সমাধিস্থ করা হয়। একসময় মসজিদটির নাম ‘জামি ইস্কান্দার’ থেকে ‘জামি দানিয়েল’ নামে পরিবর্তিত হয়। মূলত এটা-ই মাসজিদু যিল-কারনাইন।


নবীজির (সা.) সময় ‘আল-ইস্কান্দারিয়ার শাসক ছিলেন মিসরীয় কিবতীয় বংশীয় খৃষ্টান শাসক ‘মুকাওকিস’ যার নিকট পত্র দিয়ে নবীজি (সা.) তাঁর সাহাবী হাতিব ইবন আবি-বালতাহকে (রা.) ইস্কান্দারিয়ায় পাঠিয়েছিলেন [হাকিম, আল-মুসতাদরাক, ৫২৬৯]। মুকাওকিস পত্রটি চুমু খেয়েছেন এবং দূতকে সম্মান-মর্যাদা দিয়েছেন [বাইহাকী, দালায়িলু নবুওয়াহ, ১৭৬৬]। নবীজির (সা.) পত্রটিকে একটি হাতির দাঁতের পাত্রে যত্ন করে সংরক্ষণ করেন [ইবন সাদ, তাবাকাত আল-কুবরা, ২৯৭]। হাতিবকে (রা.) রাজ-প্রাসাদে থাকার ব্যবস্থা করেছেন এবং রাজন্যবর্গের সভায় হাতিবের (রা.) সাথে কথা বলে নবীজি (সা.) সম্পর্কে অনেক তথ্য অবহিত হয়েছেন [বাইহাকী, দালাইলু নবুওয়াহ, ১৭৬৭]।  তারপর নবীজির নিকট পত্রসহ ইস্কান্দারিয়ার উচ্চ পারিবারিক মর্যাদাসম্পন্ন কিবতী নারী ‘মারিয়া’, তার বোন সিরীন ও অপরিমেয় অর্থ-সম্পদের হাদিয়া পাঠিয়েছিলেন মদীনায়। তাঁরা উভয়ে ঈমান আনলে নবীজি (সা.) নিজে মারিয়াকে বিবাহ করেছেন এবং বোনটিকে হাদীয়া করেন সাহাবী হাস্সান ইবন সাবিতকে (রা.) [হাকিম, আল-মুসতাদরাক, ৬৮৭৩]। হাস্সান ইবন সাবিতের এ  সংসারে ‘আব্দুর রহমান’ নামে একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়েছিলো, যিনি নবী পুত্র ইবরাহীমের খালাতো ভাই। তবে ইতিহাসে তার কোনো উপাত্ত নেই [যুবাইর ইবন বাক্কার, আল-আখবর, ১/২৩৭]। কোনো কোনো রিওয়ায়াত অনুযায়ী সিরীনের বিয়ে হয়েছিলো যাহম ইবন কাইস আল-আবদারীর (রা.) সাথে এবং তাদের সন্তান যাকারিয়া ইবন যাহম (রা.) মিসর বিজয়ী সাহাবী আমর ইবন আল-আসের (রা.) শাসনকালে মিসরে প্রশাসক নিযুক্ত হয়েছিলেন [তাহাবী, মাসকিলুল আসার, ২১৬১]।  ইস্কান্দারিয়া থেকে পাঠানো উপটোকনের মাঝে সিরিয় সুরমাদানী, একটি আয়না ও একটি চিরুনী ছিলো [তাবারানী, আল-মুজাম আওসাত, ৭৪৯৯]। তাতে আরো ছিলো একটি জুব্বা ও জিনসহ একটি খচ্চর [তাহাবী, মাসকিলুল আসার, ৩৭১৪]। কোনো কোনো রিওয়ায়াতে এটা-ই ছিলো মুকাওকিসের খচ্চর দুলদুল বাহন, সাথে তার উফাইর বা ইয়াফুর নামক গাধা, এক হাজার মিসকাল স্বর্ণ, বিশটি কোমল কাপড়! ইস্কান্দারিয়ার এসব উপটোকন ছিলো হাতিব ইবন আবি বালতার (রা.) ফিরতি কাফিলায়। [ইবন সাদ, তাবাকাত আল-কুবরা, ১৩১৫]।


অন্য একটি রিওয়ায়াত অনুযায়ী মুকাওকিস পূর্বে-ই নবীজি (সা.) সম্পর্কে জানতে পেরেছিলেন। মুগিরা ইবন শু’বা (রা.) ইসলাম গ্রহণের পূর্বে ইস্কান্দারিয়ার উপকূলে বিলাসাশ্রমে মুকাওকিসের সাথে কথোপকথনে নবীজির বংশের পবিত্রতা, তার অনুসারীদের দারিদ্ররা, দেশত্যাগ ও ইহুদিদের প্রত্যাখ্যান, যুদ্ধ জয় ইত্যাদি প্রসংগ উঠে আসে [ইবন আসাকির, তারীখু  দামিস্ক, ৬৪৭৯১]। 


দ্বিতীয় খলীফা ওমরের (রা.) সময় সাহাবী আমর ইবন আল-আসের (রা.) নেতৃত্বে একদল মুসলিম সেনা ইস্কান্দারিয়ায় প্রবেশ করেন। আমর ইবন আল-আস (রা.) সেখানকার শাসকের সম্মুখে উপনীত হয়েছিলেন। তাঁর জন্য মিম্বর স্থাপন করা হয়েছিলো এবং সেখানে দাঁড়িয়ে তিনি আরবদের জীবন-যাপন, নবীজির বিপ্লবের বাণী, লড়াই-সংগ্রাম, সংস্কার-সংশোধন ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়ে এক বৈপ্লবিক ভাষণ দেন। সেখানকার শাসক নবীদের কর্মপদ্ধতি স্বীকার করেন এবং তাদের জনপদে নবীদের ভূমিকা তুলে ধরেন। পরবর্তী শাসকদের পরিবর্তনের অভিজ্ঞতাও বর্ণনা করেন [আবূ ইয়ালা, আল-মুসনাদ, ৭২৯৮]। ইতিহাস ও ফিকহের কিতাবগুলোতে ইস্কান্দারিয়ার বিজয় কিভাবে হয়েছিল তা নিয়ে মতামত রয়েছে। কারো মতে তা যুদ্ধের মাধ্যমে বিজিত হয়েছে [ইবন খাইয়াত, আত-তারীখ, ১/৮০]। এটা ঠিক যে, ইস্কান্দারিয়াবাসী বাধা দিয়েছিলো [ইবন হাজার, আল-মাতালিব আল-আলিয়া, ৪৫২৮]। তারপর তিনি শহরের উপর ‘মেনজেনিক’ ক্ষেপনাস্ত্র স্থাপন করেছিলেন [বাইহাকী, আস-সুন্নান আস-সগীর, ১৬২৮]। সেদিন মুসলিম বাহিনী আমর ইবন আল-আসের (রা.) নেতৃত্বে ‘সালাতুল খাওফ’ তথা ভীতির সালাত আদায় করেছিলেন [ইবন মানসূর, আস-সুনান, ২৩৫১]। যুদ্ধ শেষে যুদ্ধলব্ধ সম্পদ বন্টন করেছিলেন [মুসনাদু ইকবা ইবন আমির, ২৪৬]। এতে প্রতিয়মান হয়, সেখানে যুদ্ধ হয়েছিলো।  


এ শহরে একবার ভ্রমণে বের হয়েছিলেন সাহাবী উকবা ইবন আমের (রা.)।  তাঁর সাথে ছিলেন ইস্কান্দায়ির অধিবাসী আবূ আলী আল-হামাদানী। সালাতে সময় আবূ আলী তাকে বলেন, আমাদের ইমামতি করুন! তিনি তা অসম্মতি জ্ঞাপন করে বলেন, আমি পারবো না! আমি নবীজি (সা.) বলতে শুনেছি, ‘যে মানুষের ইমামতি করে এবং সঠিক সময়ে ও যথাযথভাবে তা সুসম্পন্ন করে, তার জন্য সাওয়াব রয়েছে এবং তাদের জন্যও সাওয়াব রয়েছে। কিন্তু যে তাতে কোনরূপ ত্রুটি করে, তার উপর সকল দায় বর্তাবে এবং মানুষের উপর কিছু বর্তাবে না” [আল-বাইহাকী, আস-সুনান আল-কুবরা, ৪৯০৬]।



সাহবীদের একটি অংশ ‘আল-ইস্কান্দারিয়ায় বসতি স্থাপন করেছিলেন। খলীফার অনুমতি ও আদেশক্রমে মিসরের বিভিন্ন শহর, উপকূলীয় এলাকায় বসবাসরত মুসলিমদের জন্য সর্বপ্রথম ইস্কান্দারিয়াতে জুমার সালাতের ব্যবস্থা করা হয়। ওমর (রা.) ও উসমান (রা.) উভয়ে-ই উক্তরূপ আদেশ দিয়েছেন বর্ণিত হয়েছে [আল-বাইহাকী, আস-সুনান আল-কুবরা, ৫১৭১]।


নাঈম ইবন হাম্মাদের ‘কিতাবুল ফিতান’ গ্রন্থে ‘ইস্কান্দারিয়া ও মিসরের উপকন্ঠ সম্পর্কিত রিওয়ায়াত” শিরোনামে একটি স্বতন্ত্র পরিচ্ছেদ রয়েছে। এতে প্রতিয়মান হয় ‘মালহামা আল-কুবরা’ তথা পৃথিবী সমাপ্তির পূর্বে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে নির্মম যুদ্ধের যে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে, তার শুরু হবে ‘ইস্কান্দারিয়া’ থেকে। আবূ যর হতে বর্ণিত আছে, ”বনু উমাইয়ার নিকৃষ্টতম এক লোক মিশরের শাসন ক্ষমতা লাভ করবে। তারপর তার উপর কেউ বিজিত হবে কিংবা তার হাত থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়া হবে। অতপর সে রোমে পালিয়ে যাবে। অতঃপর মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য রোমানদের নিয়ে আসবে। সেটিই হবে মালহামার শুরু [নাঈম ইবন হাম্মাদ, কিতাবুল ফিতান, ১৩২৪]। কোনো বর্ণনায় সুস্পষ্টভাবে বলা আছে ‘সে রোমানদের নিয়ে ইস্কান্দারিয়ায় আসবে’ [আহমদ আশ-সিরাজী, আল-যুজ আত-তাসি, ১৭৯]। 


মিসর বিজয়ী সাহাবী আমর ইবন আল-আস (রা.) নিজে ইস্কান্দারিয়ায় বসবাস করতেন এবং সর্বশেষ যুদ্ধের বিষয়ে সর্তক ছিলেন। একবার ইসকান্দারিয়ায় উপকূলে কতগুলো নৌযান দেখে লোকজন ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে তাঁর কাছে ছুটে আসলো। তিনি বললেন, আমার অশ্বে জীন বাধোঁ! তারপর জিজ্ঞেস করলেন, কোন দিক থেকে দেখা যাচ্ছে? লোকেরা বললো, মিনারার দিক থেকে। তিনি বললেন নিশ্চিন্ত থাকো। আমরা ভয় করি পশ্চিম দিক থেকে আসাকে [নাঈম ইবন হাম্মাদ, কিতাবুল ফিতান, ১৪১৪]। অন্য হাদীসে আছে, লোকেরা বলেছিলো, নৌযানগুলো ‘কুবরুস’ তথা সাইপ্রাসের দিক থেকে আসছে। তিনি বললেন, এটা মালাহামা ইস্কান্দারিয়া নয়; অবশ্য-ই তারা আসবে পশ্চিম দিক থেকে -‘আন্তাবুলুস’ থেকে [নাঈম ইবন হাম্মাদ, কিতাবুল ফিতান, ১৪২৭]। ‘আন্তাবুলুস’ বর্তমান  লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপলীর প্রাচীন নাম, যাকে আরবীতে ‘তারাব্লিস’ বলা হয়।  তিনি বিশ্বাস করতেন, শেষ সময়ের যুদ্ধে রোমানরা ইস্কান্দারিয়া আক্রমণ করবে ‘লুবিয়া’ তথা লিবিয়ার ‘আন্তাবুলুস’ তথা ত্রিপলী হয়ে [নাঈম ইবন হাম্মাদ, কিতাবুল ফিতান, ১৪২৯]। জীবনের শেষ দিকে এসে তাঁর আরো বিশ্বাস জন্মে, শেষ সময়ের যুদ্ধ তাঁর সময়ে নয়; বরং তা অনেক পরের দিকে।  তিনি ইস্কান্দারিয়া যুদ্ধের আরো বিভিন্ন ভবিষ্যতবাণী করেছেন। তাঁর পুত্র আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইবন আল-আস (রা.) মালাহামা ইস্কান্দারিয়া বিষয়ে ভবিষ্যতবাণী করেছেন, “যখন তোমরা আরব নেতাদের মধ্য থেকে দুই নেতাকে রোমের দিকে পালিয়ে যেতে দেখবে, তখন মনে রেখো, সেটাই মালহামা ইস্কন্দারিয়ার আলামত [নাঈম ইবন হাম্মাদ, কিতাবুল ফিতান, ১৪২৬]।


ইস্কান্দারিয়া বিষয়ে আরো অনেক রিওয়ায়াত আছে। এসব রিওয়ায়াত মানগত দিক থেকে দূর্বল হলেও ইতিহাসের তথ্য-উপাত্ত ও সম্ভাব্য ভবিষ্যত নির্দেশনা বিষয়ে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন যোগ্য। উম্মাহর আলিমগণ তাদের কিতাবে এসব তথ্য লিপিবন্ধ করে রেখেছেন উম্মাহর প্রয়োজনে ও কল্যাণে। এসব উপাত্তের উপস্থিতি যেভাবে ভূমিকম্পে ইস্কান্দারিয়ার বাতিঘর ধ্বংসের প্রচলিত ধারণাকে নাকচ করে দেয়, তেমনি খলীফা ওমরের নির্দেশে ইস্কান্দারিয়ার পাঠাগার জ্বালিয়ের দেয়ার গল্পকে মিথ্যা সাব্যস্ত করে। মুসলিম সৈন্যবাহিনীর রাজ্য বিস্তারের ইতিহাসে কোনো জনপদে এমন কলঙ্কময় ঘটনার রেকর্ড নেই; বরং তাদের রাজ্য বিস্তার জ্ঞান-বিজ্ঞানের দ্বার উম্মুক্ত করেছে। ইস্কান্দারিয়ায় ইতিহাসেও তার ভিন্নতা নেই। বিদ্যান আর গুণিজনরা ধ্যান-জ্ঞানের জন্য আসতেন এই শহরে!  


ইবরাহীম ইবন আদহাম এসেছিলেন ইস্কান্দারিয়ায়। তিনি বলেন, আমি ইস্কান্দারিয়ায় প্রবেশ করলাম। আসলামা ইবন যায়িদ আল-জুহানী নামক এক শাইখের সাথে সাক্ষাত করলাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় থেকে এসেছো? বললাম, খুরাসান থেকে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, দুনিয়া ত্যাগ করতে তোমাকে কীসে প্রলুব্ধ করলো? বললাম, দুনিয়ার প্রতি ক্লান্তি এবং আল্লাহর নিকট উত্তম বিনিময়ের প্রত্যাশা! [বাইহাকী, শুআবুল ঈমান, ৯৩৩৬]। দীর্ঘ রিওয়ায়াতটিতে সবর, বাসস্থানের দৈন্যতা, দুনিয়া বিরাগ ইত্যাদি নিয়ে আরো আলাপ আছে। 


আলেকজান্দ্রিয়া হাজার বছরের সভ্য নগরী। ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ শাসকরা এই শহর নির্মাণ করেছেন এবং সাগর উপকূলে বিশ্রামাগার স্থাপন করেছেন। হাজার বছরে ধরে পর্যটকদের চিত্তে প্রশ্বস্তি এনে দেয়েছে এ নগর। ইস্কান্দারিয়ার স্থিতি দীর্ঘ হোক। 


এ লেখকের আলেকজান্দ্রিয়া ভ্রমণের কেনো অভিজ্ঞতা নেই। তাই এ নিবন্ধে আলেকজান্দ্রিয়ার রূপ-সৌন্দর্য্য বিষয়ে নূন্যতম স্পর্শ করা হয়নি। ফলে এখানে পাঠকের মুগ্ধতা শুন্য! ইমাম জালালুদ্দিন সূয়ূতির বর্ণনা হয়তো সে শুন্যতা পূরণ করতে পারে।


“ইস্কান্দারের এক ভাই ছিলো, নাম ‘আল-ফারমা’। ইস্কান্দার যখন ইস্কান্দারিয়া নির্মাণ করেন, তখন আল-ফারমা ইস্কান্দারিয়র সমমানে নির্মাণ করেন ‘ফারমা’ নগরী। ইস্কান্দারিয়া কখনো তার দীপ্তি হারায়নি! অন্যদিকে ফারমা নির্মাণের পর থেকে যেনো বিধ্বস্ত-ম্লান। ইস্কান্দারিয়া বিজয়ের পর আওফ ইবন মালিক অধিবাসীদের বললেন, কী সুন্দর তোমাদের এই নগরী! তারা বললো, ‘ইস্কান্দার এই নগরী নির্মাণ করে বলেছিলো, ’এটি এমন একটি শহর যা আল্লাহর কাছে নগন্য আর মানুষের নিকট সমৃদ্ধ’,তাই তার দীপ্তি বহমান। ফরমা বিজয়ের পর আবরাহা ইবন সাবাহ অধিবাসীদের বললেন, কী জীর্ণ তোমাদের এই নগরী! তারা বললো, ‘ফারমা এই নগরী নির্মাণ করে বলেছিলো, ’এটি এমন একটি শহর যা আল্লাহ হতে সমৃদ্ধ আর মানুষের কাছে নগন্য’, তাই তার রূপ নিষ্প্রভ।"  [সূয়ূতি, হুসনুল মুহাদারা, পৃ. ৯৩]


[কুরআনের দেশে: ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সন্ধানে, মিসর অধ্যায়, ড. মুহাম্মদ তাজাম্মুল হক]

No comments

Powered by Blogger.