Header Ads

আগামীকাল নতুন সুর্য উঠবে। নতুন দিন শুরু হবে। নতুন একটি পৃথিবীর যাত্রা শুরু হবে। সেই পৃথিবীটা শুধু আল-কোরআনের। এই সপ্ন প্রত্যহই দেখি। শুধু বান্তবায়ন সময়ের অপেক্ষা............

ওসমান (রাঃ) এর শাহাদাতের কারন



হযরত ওসমানের খেলাফতের প্রথম ছয় বৎসর নিতান্ত শান্তির সথেই অতিবাহিত হয়, কিন্তু দ্বিতীয় ছয় বৎসরে যেন দুনিয়ার পরিবেশই পরিবর্তিত হয়ে যায়। এই পরিবর্তনের একমাত্র কারণ ছিল, সাহাবায়ে কেরামের যে পবিত্র জামাত রসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের মোবারক সহচর্য হইতে ঐক্য ও জীবনদর্শনের শিক্ষা লাভ করেছিল, তাঁরা ধীরে ধীরে দুনিয়া হতে বিদায় হয়ে যাচ্ছিলেন। পরবর্তী যে জনমণ্ডলী এই মহান জামাতের উত্তরাধিকার লাভ করেছিল, আত্মত্যাগ ও খোদাভীরুতার দিক দিয়ে তাঁহারা পূর্ববর্তীদের সার্থক উত্তরাধিকার লাভ করতে সমর্থ ছিল না। রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের সাহাবীগণের সবচাইতে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল- তাঁদের জীবন-মরণ নিবেদিত ছিল একমাত্র আল্লাহর জন্য। যেহেতু তাঁরা স্বার্থবুদ্ধির ঊর্ধ্বে ছিলেন,  এ জন্য কোন প্রকার অন্তর্বিরোধ ও মনকষাকষি তাদেরকে স্পর্শ করতে পারেনি, কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে যাঁহারা ময়দানে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, তাঁহারা ততটুকু নিষ্ঠাবান ও স্বার্থহীন ছিলেন না। ফলে পরস্পরের মধ্যে স্বার্থের প্রশ্নে সংঘাত স্বাভাবিকভাবেই দেখা দিতে থাকে। যার অন্তরে তাওহীদের জ্যোতি যত অধিক হয় ততই তিনি স্বর্থপরতা, বিশ্বাসঘাতকতা, প্রবঞ্চনা ও মোনাফেকী হণতে দূরে থাকতে সমর্থন হন। যে সমস্ত লোক এই সমস্ত গ্লানি ও বিচ্যুতি হতে যত বেশী পবিত্র হবেন তারা পরস্পর তত বেশী ঐক্য বন্ধনে আবদ্ধ হতে সমর্থ হবেন, কিন্তু তাওহীদের জ্যোতি যতই হ্রাসপ্রাপ্ত হতে শুরু করে, ততই স্বার্থ ও সংঘাত-বুদ্ধি আসিয়া সে স্থান পূরণ করতে শুরু করে। ফলে পরস্পরের আন্তরিক ঐক্য বিনষ্ট হতে থাকে। এই আন্তরিক ঐক্য বিনষ্টের পরিণতি স্বরুপ ইসলামী খেলাফতের মজবুত দুর্গ অল্প দিনের মধ্যে ভেঙ্গে পড়েছিল
হযরত ওসমানের যুগে নিম্নোক্ত তিন প্রকার মতবিরোধ সৃষ্টি হয়ঃ
(ক) বনী উমাইয়া ও বনী হাশেমের মধ্যে মতবিরোধ
হাশেমীগণ নিজেদের রসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের উত্তরাধিকারী মনে করতপূর্ববর্তী গোত্রীয় অনৈক্যের পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহর রসূলের খেলাফত তাদের গোত্রীয় প্রতিদ্বন্দ্বী উমাইয়া বংশের কারো অধীন থাকুক, ইহা হাশেমীগন মনে-প্রাণে মেনে নিতে পারেনি
(
খ) কোরায়শ ও অ-কোরায়শদের মধ্যে অনৈক্য
মুসলমানদের সংখ্যা দিন দিন বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পাচ্ছিলইসলামী রাষ্ট্রের বিস্তৃতির ব্যাপারে কোরায়শদের সঙ্গে সঙ্গে আরবরে অন্যান্য গোত্রের লোকও সমানভাবে অংশ গ্রহণ করেএই জন্য অ-কোরায়শগণ চাইতো না যে, নেতৃত্বের মুকুট কেবলমাত্র কোরায়শগণের মস্তকেই শোভিত হোক
(
গ) আরব-অনারবে অনৈক্য
ইসলামের জ্যোতি আরবের বাহিরে সিরিয়া, গ্রীস ও মিসর পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছেছিল। ইহুদী, খৃষ্টা্‌ অগ্নিউপাসক প্রভৃতি বিভিন্ন ধর্মের অগণিত লোক ইসলামের দীক্ষা নিয়েছিলেন। ইসলামী ঐক্যের ভিত্তিতে তারাও অধিকারের ক্ষেত্রে নিজেদেরকেআরবদের সমধিকারী বলে দাবী করত। আরবদের একচ্ছত্র অধিকার তারা সহ্য করতে পারছিলনা। এক কথায়, বনী হাশেমের অন্তর বনী উমাইয়ার সাথে একত্রিত হচ্ছিল না। আরবের সাধারণ অধিবাসী কোরায়শদের আর অনারব জাতিগুলি আরবদের আধিপত্য বরদাশ্ত করতে পারছিল না। এইভাবে ইসলামী রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরে পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ, অনৈক্য ও শত্রুতার বীজ ধীরে ধীরে বিস্তৃত হয়
(
ঘ) ধ্বংসাত্মক শক্তির সংগঠন
সর্বপ্রথম কুফায় ধ্বংসাত্মক শক্তি দানা বেধে উঠে। আশ্তার নাখয়ী নামক জনৈক অনারব প্রভাবশালী ব্যক্তি প্রচার শুরু করেন, ইসলামী বিধানমতে মুষ্টিমেয় কোরায়শের পক্ষে সমগ্র মুসলিম জাতিকে পদানত রাখার কোন অধিকার নাই। সাধারণ মুসলমানগণ সকলে মি্লে রাজ্য জয় করেছে, এই জন্য ইসলামী রাষ্ট্রে প্রত্যেক মুসলিমের নেতৃত্ব করার অধিকার আছেঅনারবগণ আশতার নাখয়ীর এই মতবাদ অতি সহজেই গ্রহণ করতে শুরু করে। ইহাদের প্রচেষ্টায় একটি ষড়যন্ত্রকারী দল গড়ে উঠে। তারা কুফার শাসনকর্তা সায়ীদ ইবনুল আস (রা)-এর বিরুদ্ধে নানা প্রকার অপপ্রচার শুরু করে। সায়ীদ ইবনুল আস অপপ্রচারকারীগণকে দমন করার জন্য হযরত ওসমানের অনুমতিক্রমে তাদের দশ জন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিকে সিরিয়ায় নির্বাসিত করেন। ইহার ফলে বসরায়ও একটি বিপ্লবী দল গড়ে উঠে। কুফা ও বসরায় আশ্তার নাখয়ী যে কাজ শুরু করেছিল, মুনাফেক আবদুল্লাহ ইবনে সাবা পূর্বেই মিসরে তা শুরু করেছিল। আবদুল্লাহ ইবনে সাবা জনৈক নও মুসলিম, যে পূর্বে ছিল ইহুদী। বসরা ও কুফার বিপ্লবীদের কথা জানতে পেরে সে অত্যন্ত উৎফুল্ল হয়ে উঠেঅল্প দিনের মধ্যে সে বিভিন্ন ধ্বংসাত্মক শক্তির মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করতঃ এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, হযরত ওসমানকে খেলাফতের পদ হতে বিচ্যুত করে বনী উমাইয়ার শক্তি চিরতরে নষ্ট করে দেওয়া উত্তম হবেআবদুল্লাহ ইবনে সাবা চারিদিকে অতি দ্রুততার সহিত তার প্রচারক দল প্রেরণ করে দিল। তাহার প্রচারকরা বাহ্যিক ধার্মিকতার বেশ ধরে প্রথমে সাধারণ মুসলমানদের আস্থা অর্জন করলঅতঃপর হযরত ওসমান (রা) ও তার শাসনকর্তাদের বিরুদ্ধে নানাপ্রকার অপপ্রচার করতঃ সাধারণ মানুষকে উত্তেজিত করে তুলত। তারা ইসলামের দোহাই দিয়ে সাধারণ মুসলমানদের অন্তরে খলিফার প্রতি সম্ভ্রমবোধ শিথিল করে দিয়েছিল।
বিপ্লবী প্রচারণা এতদূর সাফল্য লাভ করেছিল যে, মোহাম্মদ ইবনে আবু হোযাইফা এবং মোহম্মদ ইবনে আবু বকরের ন্যায় লোক পর্যন্ত অপপ্রচারকারীদের দলে ভিড়ে পড়লপরিস্থিতি এই পর্যন্ত গড়াল যে, খোদ মদীনার অবস্থাও বিশেষভাবে পরিবর্তিত হতে শুরু করল। একদিন হযরত ওসমান (রা) জুমার খুৎবা দিতে দাড়িয়ে আল্লাহর প্রশংসা কীর্তন শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে এক ব্যক্তি দাড়িয়ে বলতে লাগল, ওসমান আল্লাহর কিতাব অনুসরণ করে চল। হযরত ওসমান (রাঃ) নিতান্ত নম্রভাবে বললেন, আপনি বসে পড়ুন, কিন্তু লোকটি খুৎবার ভিতরে আবার উঠে দাড়াল এবং পূর্ব কথার পুনরাবৃত্তি করল। হযরত ওসমান (রা) তাকে পুনরায় বসে পড়ার জন্য অনুরোধ করলেন। সে বসে পড়ল এবং আবার উঠে দাড়াল। ধৈর্য ও নম্রতার প্রতিমূর্তি হযরত ওসমান (রা) তাতেও উত্তেজিত হলেন না। নিতান্ত নম্রভাবে বলিলেন, আপনি বসে পড়ুন এবং খুৎবা ‍শুনুনকিন্তু যেহেতু এসব একটি সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের ভিত্তিতে করা হয়েছিল, এজন্য এবার লোকটির বিরাট একদল সমর্থক উঠে দাড়াল এবং হযরত উসমানকে ঘিরে ফেলে নির্মমভাবে প্রস্তর নিক্ষেপ করতে লাগল তাতে আল্লাহর রসূলের খলিফা আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন, কিন্তু হযরত ওসমানের কি অপরিসীম ধৈর্য, তিনি বিশৃংঙ্খলা সৃষ্টিকারীদেরকে কিছুই বললেন না; বরং সবাইকে ক্ষমা করে দিলেন।
বিশৃংখলা সৃষ্টিকারীদের অপবাদ
বিশৃংখলা সৃষ্টিকারীদের তরফ হতে হযরত ওসমানের উপর পাঁচটি অপবাদ আরোপ করা হয়। যথা-
(
১) তিনি বিশিষ্ট সাহাবীগণকে রেখে নিজের অযোগ্য আত্মীয়-স্বজনদের রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করেছিলেন
(
২) তিনি তার আপন লোকদে মধ্যে বায়তুল মালের অর্থ বণ্টন করেছেন।
(
৩) তিনি হযরত যায়েদ ইবনে সাবেত (রা) কর্তৃক লিখিত কোরআন ব্যতীত অবশিষ্ট সমস্ত কপি জ্বালিয়ে দিয়েছেন।
(
৪) তিনি কতিপয় সাহাবাকে অপদস্থ করেছেন এবং কতিপয় নূতন নূতন বেদআতের সৃষ্টি করেছেন।
(
৫) মিসর হতে আগত প্রতিনিধিদলের সাথে প্রকাশ্য বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন।
উপরোক্ত অভিযোগ গুলি ছিল সম্পূর্ণরূপে ষড়যন্ত্র প্রসূত। যথা-
(
১) সাহাবীগণের সরকারী দায়িত্ব হতে পদচ্যুতি ছিল নিতান্তই শাসনতান্ত্রিক ব্যাপার।
(
২) আপন লোকদিগকে তিনি যাহা কিছু দিয়েছিলেন তা সম্পূর্ণ তাঁহার ব্যক্তিগত সম্পত্তি হতে দেওয়া হয়েছিল।
(
৩) তিনি কোরআনের যে কপি সংরক্ষিত করেছিলেন, তা হযরত আবু বকর (রা) কর্তৃক সংগৃহীত ও সংকলিত ছিল। সুতরাং তার চাইতে নির্ভুল কপি আর কি হইতে পারে?
(
৪) যে সমস্ত বেদাআতের কথা বলা হত, তাহা সম্পূর্ণই ইজতেহাদী ব্যাপার। সুতরাং এগুলুকে বেদআত কিছুতেই বলা চলে না।
(
৫) মিসরীয় প্রতিনিধিদলের বিবরণ আমরা পরে দিচ্ছি
শাসনকর্তাদের সম্মেলন
হযরত ওসমান (রা) রাষ্ট্রব্যাপী ধ্বংসাত্মক শক্তির ব্যাপক অভ্যুদয়ের কথা জানতে পেরে প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের এক সম্মেলন আহ্বান করেন। সম্মেলনে তাকে নিম্নোক্ত পরামর্শ দেয়া হয়েছিল
১।আবদুল্লাহ ইবনে আমের পরামর্শদেনঃ কোন দেশে সৈন্য প্রেরণ করতঃ লোকদেরকে জেহাদে নিয়োজিত করে দেয়া হউক। ইহাতে বিশৃঙ্খলা আপনা হতেই দূর হয়ে যাবে।
২।আমির মোয়াবিয়া পরামর্শদেনঃ প্রত্যেক প্রদেশের শাসনকর্তা নিজ নিজ প্রদেশ রক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করলে বিশৃঙ্খলা লাগভ হবে
আমর ইবনুল আস পরামর্শদেন : আপনি সুবিচার করেন, অন্যথায় খেলাফত হতে পদত্যাগ করেন কিন্তু সম্মেলন শেষে হযরত আমর ইবনুল আস (রা) হযরত ওসমানের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে নিয়ে বললেন, আমি বিদ্রোহীদের আস্থা অর্জন করার জন্য প্রকাশ্যেএই প্রস্তাব করেছিলাম, যাতে এখন থেকে আমি তাদের গোপন কার্যকলাপ সম্পর্কে আপনাকে অবহিত করতে পারিসম্মেলন সমাপ্ত হওয়ার পর হযরত ওসমান (রা) সবদিক বিবেচনা করে তিনটি কর্মপন্থা গ্রহণ করলেন।
(
১) কূফার শাসনকর্তা সাদ ইবনুল আসকে পদচ্যুত করে তদস্থলে হযরত আবু মূসা আশ্‌আরী(রাঃ) কে প্রেরণ করলেন।
(
২) প্রত্যেক প্রদেশের শাসন-ব্যবস্থা সম্পর্কে তদন্ত করার জন্য একটি তদন্ত কমিশন গঠন করে প্রদেশগুলোতে প্রেরণ করলেন।
(
৩) সাধারণভাবে ঘোষণা করে দিলেন, হজ্বের সময় প্রত্যেকেই স্ব-স্ব অভিযোগ পেশ করবেন, যাতে ঐগুলির যথাযোগ্য প্রতিকার করা যায়
বিদ্রোহীদের মদীনা আক্রমণ
বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীরা সংস্কার চাইতো না। এই জন্য হযরত ওসমান (রা) যখন শাসন-ব্যবস্থা ব্যাপক সংস্কারে হাত দিলেন, ঠিক সেই মুহূর্তে তারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে মদীনার দিকে অগ্রসর হতে শুরু করল। পথে উহারা নিজদিগকে হজ্বযাত্রী বলে পরিচয় দিচ্ছিল। মদীনার নিকটবর্তী হয়েই তারা সৈনিকের বেশ ধারণ করে বিভিন্ন স্থানে শিবির স্থাপন করল। বিদ্রোহীদে খবর পেয়ে হযরত ওসমান (রা) হযরত তালহা, হযরত ‍যুবাইর, হযরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস এবং হযরত আলীকে একে একে প্রেরণ করে বিদ্রোহীদিগকে নিজ নিজ এলাকায় ফিরে যাওয়ার জন্য উপদেশ দিলেন। তিনি তাদেরকে নিশ্চয়তা দিলেন যে, তাহাদের প্রত্যেকটি সঙ্গত দাবী-দাওয়া পূরণ করা হবে। পরিস্থিতি বিবেচনার জন্য মসজিদে সভা আহ্বান করা হল। তালহা ইবনে আবদুল্লাহ (রা) দাড়িয়ে খলিফার সাথে কঠোর ভাষায় কথোপকথন করলেন। হযরত আয়েশা সিদ্দিকার তরফ হইতে পয়গাম আসল, আবদুল্লাহ ইবনে আবি সারাহর মত ব্যক্তি, যার উপর সাহাবী হত্যার অভিযোগ রয়েছে, তাকে আপনি কেন মিসরের শাসনকর্তৃত্বের পদ হতে অপসারণ করছেন না। হযরত আলীও এই মত সমর্থন করলে খলিফা বললেন, মিসরের বিক্ষোভকারীরা স্বয়ং তাদের শাসনকর্তা নির্বাচিত করুক, আমি তাকেই আবদুল্লাহ ইবনে আবি সারাহর স্থানে নিযুক্ত করব। বিদ্রোহীদের পক্ষ হতে মোহাম্মাদ ইবনে আবু বকরের নাম প্রস্তাব করা হল। হযরত ওসমান (রা) তার নামে ফরমান লিখে দিলেন। মোহাম্মাদ ইবনে আবু বকর কিছু সংখ্যক মোহাজের ও আনসারকে সঙ্গে নিয়ে মিসরের পথে রওয়ানা হয়ে গেলেন। ব্যাপারটা তখনকার মত এখানেই মিটে গেল।
এই ঘটনার কিছু দিন পর আবার প্রচারিত হল, বিদ্রোহীরা পুনরায় মদীনায় প্রবেশ করছে। মুসলমানগণ বাহির হইয়া দেখলেন, মদীনার অলিতে-গলিতে প্রতিশোধ প্রতিশোধরব উঠছে। মদীনাবাসীগ বিদ্রোহীদের নিকট এইরূপ আশ্চর্যজনক প্রত্যাবর্তনের কথা জিজ্ঞাসা করলে, তারা হযরত ওসমানের উপর এমন অদ্ভুত অভিযোগ উত্থাপন করল যে, সকলেই স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। তারা বলতে লাগল, মোহাম্মদ ইবনে আবু বকরের কাফেলা তৃতীয় মঞ্জিলে পৌঁছলে দেখা গেল, জনৈক সরকারী উষ্ট্রারোহী দ্রুত মিসরের দিকে গমন করতেছে। মোহাম্মদ ইবনে আবু বকরের সঙ্গীগণ তাকে ধরে ফেললেন। তাহারা লোকটিকে জিজ্ঞাসা করল, ‍তুমি কে এবং কোথায় যাচ্ছ? উত্তরে লোকটি বলল, আমি আমীরুল মোমেনীনের ক্রীতদাস, মিসরের শাসনকর্তার নিকট গমন করতেছি। লোকেরা মোহাম্মদ ইবনে আবু বকরকে দেখিয়ে বলল, ইনি মিসরের শাসনকর্তা। লোকটি বলল, ইনি নন, এই বলিয়া সে পুনরায় চলতে শুরু করল। লোকেরা তাকে পুনরায় ধরে ফেলল এবং তল্লাশি করে তার নিকট একটি পত্র পাওয়া গেল। পত্রটিতে হযরত ওসমানের সীলমোহর লাগানো ছিল এবং লেখা ছিল- মোহাম্মদ ইবনে আবু বকর ও তাহার সহিত অমুক অমুক যখনই তোমার নিকট পৌঁছিবে, সঙ্গে সঙ্গে তাহাদিগকে হত্যা করিয়া ফেলিবে এবং প্রত্যেক অভিযোগকারীকে দ্বিতীয় নির্দেশ পাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বন্দী করিয়া রাখিবে।
বিদ্রোহীরা বলতে লাগল, হযরত ওসমান (রা) আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। আমরা তার প্রতিশোধ গ্রহণ করব। হযরত আলী, হযরত তাল্‌হা, হযরত যুবাইর, হযরত সাদ (রা) প্রমুখ অনেক সাহাবী সমবেত হলেন। বিদ্রোহীগণ হযরত উসমানের বলে কথিত পত্রটি তাদের সম্মুখে রাখল। হযরত ওসমান (রা)-ও তথায় গমন করলেন এবং কথাবার্তা শুরু হল।
হযরত আলী (রা) বললেন : আমীরুল মোমেনীন, এই গোলাম কি আপনার?
হযরত ওসমান (লা) বলিলেন : হ্যাঁ আমার।
হযরত আলী (রা) পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন : এই উষ্ট্রীও কি আপনার?
হযরত ওসমান (রা) জওয়াব দিলেন : হ্যাঁ আমারই।
হযরত আলী (রা) জিজ্ঞাসা করলেন : পত্রে অংকিত এই সীলমোহর কি আপনার?
হযরত ওসমান (রা) বলিলেন : হ্যাঁ সীলমোহরও আমারই।
হযরত আলী (রা) বলিলেন : এই পত্রও কি আপনি লিখেছেন?
হযরত ওসমান (রা) জওয়াব দিলেন : আমি আল্লাহকে উপস্থিত জেনে এই শপথ করতেছি, এই পত্র আমি নিজে লিখি নাই, অন্য কাওকেও লিখার নির্দেশ দেই নাই, এমনকি এই সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না।
হযরত আলী (রা) বললেন : আশ্চর্যের বিষয়, পত্রবাহক গোলাম আপনার, বাহনের উষ্ট্রী আপনার, পত্রে অংকিত সীলমোহরও আপনার। অথচ আপনি পত্রের মর্ম সম্পর্কে কিছুই জানেন না।
হযরত ওসমান (রা) বললেন, আল্লাহর শপথ, আমি নিজে এই পত্র লিখি নাই, কাহাকে লিখতেও বলি নাই, উহা মিসরে প্রেরণ করতেও বলি নাই।
পত্রের লিপি পরীক্ষা করে দেখা গেল, উহা মারওয়ানের হস্তাক্ষর। এই সময় মারওয়ান হযরত ওসমানের গৃহে অবস্থান করতেছিল। লোকেরা দাবী তুলল, আপনি মারওয়ানকে আমারদের হাতে ছেড়ে দিন কিন্তু হযরত ওসমান (রা) হস্তান্তর করতে অস্বীকার করলেন। তাতে করে হাঙ্গামা শুরু হয়ে গেল। অধিকাংশ লোকের ধারণা করল, হযরত ওসামান (রা) কখনও মিথ্যা শপথ করতে পারেন না। প্রকৃতই তিনি এই সম্পর্কে কিছু জানেন না, কিন্তু কেহ কেহ বলতে লাগল, তিনি মারওয়ানকে আমাদের হাতে কেন ছেড়ে দিচ্ছেন না? আমরা অনুসন্ধান করে প্রকৃত তথ্য উদ্ধার করে নিব। যদি মারওয়ান অপরাধী প্রমাণিত হয়, তবে তিনি উহার শাস্তি ভোগ করবেন। হযরত ওসমানের ধারণা ছিল, মারওয়ানকে বিদ্রোহীদের হাতে তুলে দিলে তারা তাকে হত্যা করে ফেলবে। এই জন্য তিনি মারওয়ানকে তাদের হাতে তুলে দিতে অস্বীকার করলেন।
এর পর বিদ্রোহীরা হযরত ওসমানের গৃহ অবরোধ করে খেলাফত হতে পদত্যাগ দাবী করতে লাগল। হযরত ওসমান (রা) জওয়াব দিলেন, যে পর্যন্ত আমার শেষ নিঃশ্বাস অবশিষ্ট থাকে, আমি আল্লাহ প্রদত্ত এই মর্যদা ত্যাগ করতে পারিনা। রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের নির্দেশ মোতাবেক জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ধৈর্য ধারণ করে যাব।
দীর্ঘ চল্লিশ দিন যাবৎ অবরোধ চলল! খলিফার গৃহে খাদ্য পানীয় সরবরাহ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেয়া হল। বিদ্রোহীদের ধৃষ্টতা তখন এমন চরমে উঠেছিল যে, বিশিষ্ট সাহাবীগণকে পর্যন্ত তারা তোয়াক্কা করত না। একদিন মুসলিম জননী হযরত উম্মে সালামা (রা) কিছু খাদ্য পানীয় নিয়ে রওয়ানা হলে হতভাগারা তাকে পর্যন্ত বিমুখ করে ফিরইয়ে দিল।
হযরত ওসমান (রা) হযরত আলীকে ডেকে পাঠালেন, কিন্তু বিদ্রোহীরা তাকে ঘরে প্রবেশের অনুমতি দিল না। হযরত আলী (রা) মাথার পাগড়ি খুলে খলিফার নিকট প্রেরণ করে খালি মাথায় ফিরে আসলেন, যাতে খালি পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারেন।
মদীনার সকল কাজকর্ম হযরত আলী, হযরত তাল্‌হা ও যুবাইরের দায়িত্বে ন্যস্ত থাকত, কিন্তু এই বেদনাময় হাঙ্গামা তাদের সকল চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেলখলিফার গৃহে অবরুদ্ধদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠল, তখন হযরত ওসমান (রা) স্বয়ং গৃহের ছাদে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলেন- তোমাদের মধ্যে কি আলী রহিয়াছেন? লোকেরা বলল, না। পুনরায় বললেন, এই জনতার মধ্যে সাদ রহিয়াছে কি? লোকেরা উত্তর করল, না, তিনিও নাই। এইবার তিনি একটু দমে গেলেন। কিছুক্ষণ ভেবে পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাদের মধ্যে এমন কেহ আছে কি- যে আলীর নিকট যাইয়া বলিবে যেন এখানকার পিপাসার্তদের পানি পান করাইবার ব্যবস্থা করেন! এক ব্যক্তি নায়েবে রাসূলের এই বেদনা-বিধুর আবেদন শুনে তৎক্ষণাৎ দৌড়িয়ে হযরত আলীর নিকট এই পয়গাম পৌছালে তিনি এক মশক পানি প্রেরণ করলেন। এই পানি এমন সাধ্য-সাধনার পর পৌছানো হল যে, এতে বনী হাশেম ও বনী উমাইয়া গোত্রের কয়েকজন গোলামকে শোচনীয়রূপে আহত হতে হল। এইবার মদীনাব্যাপী খবর প্রচারিত হল, মারওয়ানকে যদি বিদ্রোহীদের হাতে সমর্পণ করা না হয় তবে হযরত ওসমানকে হত্যা করে ফেলা হবে। এই খবর শুনে হযরত আলী (রা) হযরত হাসান ও হোসাইনকে নির্দেশ দিলেন, তোমরা গিয়ে উন্মুক্ত তরবারিসহ খলিফার দ্বারে পাহারা দিতে থাক, যেন কোন বিদ্রোহী তার গৃহে প্রবেশ করতে না পারে। হযরত তালহা, হযরত যুবাইর (রা) প্রমুখ কতিপয় বিশিষ্ট সাহাবী স্বীয় সন্তানগণকে খলিফার গৃহ প্রহরা দেওয়ার জন্য প্রেরণ করলেন।
বিদ্রোহীদের প্রতি হযরত ওসমানের আবেদন
হযরত ওসমান (রা) কয়েকবারই বিদ্রোহীগনকে বুঝাতে চেষ্টা করেন। একবার গৃহের ছাদে আরোহণ করে বলতে লাগলেন, লোকসকল, ঐদিনের কথা স্মরণ কর, যখন মসজিদে নববী নেহায়েত ক্ষুদ্র ছিল। আল্লাহর রসূল (সা) বলেছিলেন, এমন কেহ আছে কি, যে মসজিদ সংলগ্ন স্থানটুকু খরিদ করে মসজিদের নামে ওয়াকফ করে দেয় এবং বিনিময়ে জান্নাতে ইহার চাইতে উৎকৃষ্ট জায়গার অধিকারী হয়। তখন কে রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের এই নির্দেশ পালন করতে অগ্রসর হয়েছিল?
লোকেরা বলল, আপনি তা পালন করেছিলেন।
হযরত ওসমান (রা) বললেন, তোমরা কি আমাকে আজ সেই মসজিদে নামাজ পড়তে বারণ করতেছ?
আবার বললেন- আমি তোমাদিগকে আল্লাহর দোহাই দিয়ে বলতেছি, তোমরা ঐ সময়ের কথা স্মরণ কর, যখন মদীনায় বীরে মাউনা ব্যতীত পানীয় জলের আর দ্বিতীয় কোন ব্যবস্থা ছিল না। সমস্ত মুসলমান তখন পানীয় জলের অভাবে কষ্টভোগ করতেছিল তখন কে রসূলুল্লাহ (সা) এর নির্দেশে এই কূপ খরিদ করে মুসলমানদের মধ্যে ওয়াক্ফ করে দিয়েছিল?
জওয়াব আসল- আপনিই করেছিলেন।
হযরত ওসমান (রা) বললেন,- আর আজ সেই কূপের পানি হতে তোমরা আমাকে বঞ্চিত করতেছ?
আবার বললেন,- মুসলিম বাহিনীর সাজসরঞ্জাম কে বর্ধিত করেছিল?
লোকেরা বলল,- আপনি।
অতঃপর বললেন, আমি তোমাদেরকে খোদার কসম দিয়ে জিজ্ঞাসা করতেছি, তোমাদের মধ্যে এমন কেহ আছে কি যে সত্যের সমর্থন করবে এবং বলবে, একদা আল্লাহর রাসূল (সা) যখন ওহুদ পর্বতে আরোহণ করলেন তখন পর্বত কাঁপতে লাগল। আল্লাহর রাসূল পর্বতের উপর পদাঘাত করে বললেন, হে ওহুদ, স্থির হও! তোমার উপর এখন একজন নবী, একজন সিদ্দিক এবং দুইজন শহীদ রয়েছে, তখন আমিও আল্লাহর রাসূলের সঙ্গে ছিলাম।
লোকেরা বলতে লাগল,- আপনি সত্য বলতেছেন।
পুনরায় বলতে লাগলেন,- লোকসকল, আল্লাহর ওয়াস্তে আমাকে বল, হোদায়বিয়া নামস স্থানে রসূলুল্লাহ (সা) যখন আমাকে দূত হিসেবে কোরায়শদের নিকট প্রেরণ করেছিলেন, তখন কি ঘটেছিল? ইহা কি সত্য নয়, তখন আল্লাহর রাসূল (সা) স্বীয় এক হাতকে আমার হাত বলিয়া তাতে তোমাদের বায়আত গ্রহণ করেছিলেন্?
জনতার মধ্য হইতে আওয়াজ আসল, আপি সত্য বলতেছেন!
কিন্তু আক্ষেপের বিষয়, আল্লাহর রাসূলের প্রতিভুর এহেন মর্যাদার কথা নিজ মুখে স্বীকার করার পরও বিদ্রোহীদের অন্তর হতে দুর্বুদ্ধি প্রশমিত হল না। হজ্বের মওসুম তখন অল্প কয়েকদিন বাকী। কিছু দিনের মধ্যেই তা শেষ হয়ে যাচ্ছিল। বিদ্রোহীদের ভয় ছিল, হজ্ব সমাপ্ত হলে মুসলমানগণ মদীনার দিকে আসতে থাকবেন। তখন তাদের দুরভিসন্ধি কার্যকর হবে না। এই জন্য বিদ্রোহীরা হযরত ওসমানকে হত্যা করার কথা ঘোষণা করে দিল। হযরত ওসমান (রা) নিজ কর্ণে এই ঘোষণা শুনতে পেরে বলতে লাগলেন, লোকসকল, কোন্ অপরাধে তোমরা আমার রক্তের জন্য পিপাসিত হয়েছ? ইসলামী শরীয়তে কোন ব্যক্তিকে হত্যার তিনটি মাত্র কারণ রয়েছে।
১। যদি সে ব্যভিচার করে, তবে তাকে প্রস্তর মেরে নিহত করা হয়। ২। যদি সে ইসলাম ত্যাগ করে, তবে এই অপরাধে তাকে হত্যা করা চলে। ৩। যদি কেহ কাহাকেও ইচ্ছাপূর্বক হত্যা করে, তবে সেই হত্যার অপরাধে তাকেও হত্যা করা যেতে পারে। এখন তোমরা আল্লাহর ওয়াস্তে বল, আমি কি কাহাকেও হত্যা করেছি? তোমরা কি আমার উপর ব্যভিচারের অভিযোগ উত্থাপন করতে পার? আমি কি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর দ্বীন পরিত্যাগ করেছি? তোমরা শুনে রাখ! আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ এক হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (সা) তার বান্দা ও প্রেরিত রাসূল (সা)। অতঃপর তোমাদের পক্ষে আমাকে হত্যা করার কোন্ সঙ্গত কারণটি অবশিষ্ট আছে?
নায়েবে রাসূলের ধৈর্য
অবস্থা যখন শোচনীয় হয়ে উঠল, তখন হযরত মুগীরা ইবনে শোবা (রা) খলিফার নিকট উপস্থিত হয়ে বলতে লাগলেন, এই পরিস্থিতিতে আমি আপনাকে তিনটি পরামর্শ দিতেছি আপনার সমর্থক যথেষ্ট পরিমাণ বীর যোদ্ধা এখানে মওজুদ রয়েছে, আপনি জেহাদের নির্দেশ দিন। অগণিত মুসলিম সত্যের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত রয়েছেযদি এই পরামর্শ গ্রহণ না করেন তবে গৃহের সদর দরজা ভেঙ্গে অবরোধ হতে বের হন এবং মক্কায় চলে যান। যদি তাহাও পছন্দ না করেন তবে আপনি সিরিয়ায় চলে যান। সেখানকার লোক বিশ্বস্ত, তারা আপনাকে সাহায্য করবে।
কিন্তু ধৈর্যের প্রতিমূর্তি হযরত ওসমান (রা) বললেন, আমি মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ করতে পারব না। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহে ওয়া সাল্লামের খলিফা হয়ে কিরূপে মুসলিম জাতির রক্ত প্রবাহিত করব। আমি সেই খলিফা হতে চাই না, যিনি মুসলিম জাতির মধ্যে রক্তারক্তির সূচনা করবেন। আমি মক্কাতেও যেতে পারি না। কেননা, আমি রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের মুখে শুনেছি, কোরায়শদের কোন ব্যক্তি পবিত্র কাবা প্রাঙ্গণে রক্তপাত করাবে। তাহার উপর অর্ধ দুনিয়ার আযাব হবে। আমি আল্লাহর রসূলের এই ভীতিপূর্ণ বাণীর উদগাতা হতে পারবনা। বাকী থাকল সিরিয়ায় যাওয়ার কথা। রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের সঙ্গসুখ এবং হিজরতের পবিত্র ভূমি পরিত্যাগ করে যাওয়া আমার পক্ষে কি করে সম্ভব? পরিস্থিতি যখন আরো শোচনীয় হয়ে উঠল তখন তিনি আবু সাওর আল-ফাহমীকে ডাকে বেদনা-বিধুর কণ্ঠে বলতে লাগলেন, মহান আল্লাহর উপর আমার বিশেষ ভরসা রয়েছে। আমার দশটি আমানত তার নিকট রক্ষিত আছেঃ
(
১) ইসলাম গ্রহণের দিক দিয়ে আমি চতুর্থ মুসলমান। (২) আল্লাহর রসূল আমার নিকট স্বীয় কন্যা বিবাহ দেন। (৩) একজনের মৃত্যু হলে দ্বিতীয় আর এক কন্যা আমাকে দান করেন। (৩) আমি জীবনে কখনও গান করি নাই। (৫) কখনও আমি অন্যায়ের ইচ্ছাও পোষণ করি নাই। (৬) যখন হতে আমি আল্লাহর রাসূলের হাতে বায়আত করিয়াছি, তার পর হতে আমার সেই দক্ষিণ হস্ত কখনও লজ্জাস্থানে লাগাই নাই। (৭) মুসলমান হওয়া অবধি প্রত্যেক জুমার দিন আমি একটি করে ক্রীতদাসকে মুক্তি দিয়েছি। ঘটনাক্রমে কখনও ক্রীতদাসের অভাব হলে আমি পরে ক্ষতিপূরণ করেছি। (৮) আমি বর্বর যুগে অথবা মুসলমান হওয়ার পর কখনও ব্যভিচার করি নাই। (৯) বর্বর যুগে অথবা মুসলমান হওয়ার পর কখনও আমি চুরি করি নাই। (১০) আল্লাহর রাসূলের পবিত্র জীবৎকালেই আমি কোরআন পাক হেফ্জ করে ফেলেছিলাম।
ক্রমে পরিস্থিতি আরও অবনতি্র দিকে যাচ্ছিলএই সময় হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা) হযরত ওসমান (রাঃ) এর খেদমতে সাতশত মোজাহেদ উপস্থিত করে বললেন আপনি নির্দেশ দিন আমরা বিদ্রোহীদের সাথে শক্তি পরীক্ষা করতেছি। তিনি জওয়াব দিলেন, আমি আল্লাহর দোহাই দিয়ে বলছি; আমার জন্য একজন মুসলমানও যেন রক্তপাত না করেগৃহে বিশটি ক্রীতদাস ছিল, তাদেরকে ডাকে বললেন, অদ্য হতে তোমরা মুক্ত এখনি তোমরা আমারা গৃহ ত্যাগ কর। তার পর আল্লাহর রাসূলের আনসারগণ ঘরে উপস্থিত হয়ে তারা পুনরায় সাহায্যের প্রতিশ্রুতি পালন করতে চাইলেন। তিনি জওয়াব দিলেন, যদি যুদ্ধ করতে চাও তবে আমি কিছুতেই অনুমতি দিতে পারবনা। আজ আমার সবচেয়েতে বড় সহযোগিতা হবে, আমার জন্য যেন কেহ তরবারি কোষমুক্ত না করে।
হযরত আবু হোরায়রা (রা) উপস্থিত হলেন এবং নিতান্ত বিনয়ের সাথে জেহাদের অনুমতি প্রার্থনা করলেন। তিনি জানতেন, নায়েবে রাসূলের সামান্য অনুমতির সঙ্গে সঙ্গেই লক্ষ লক্ষ মুসলমান তার পতাকাতলে একত্রিত হয়ে আত্মোৎসর্গ করতে প্রস্তুত রয়েছে, কিন্তু খলিফা বললেন, আবু হোরায়রা, তুমি কি সমস্ত দুনিয়ার মানুষ এমনকি আমাকেও হত্যা করতে পারবে? হযরত আবু হোরায়রা (রা) বললেন, কোন মুসলমানই এইরূপ করতে পারে না। তখন খলিফা বললেন, যদি তুমি একটি মানব সন্তানকেও অযথা হত্যা কর, তবে তুমি যেন দুনিয়ার সকল মানুষকে- গোটা মানবতাকে হত্যা করিলে। এই উক্তি দ্বারা খলিফা সূরা মায়েদার ৩২নং আয়াতের দিকে ইঙ্গিত করতেছিলেন।
مَنْ قَتَلَ نَفْسًا بِغَيْرِ نَفْسٍ أَوْ فَسَادٍ فِي الْأَرْضِ فَكَأَنَّمَا قَتَلَ النَّاسَ جَمِيعًا وَمَنْ أَحْيَاهَا فَكَأَنَّمَا أَحْيَا النَّاسَ جَمِيعًا
অর্থাৎ-" নরহত্যা অথবা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ করার কারণ ব্যতীত যদি কেউ কাউকে হত্যা করে সে যেন দুনিয়ার সকল মানুষকেই হত্যা করল। যদি কেউ একটি প্রাণ রক্ষা করে সে যেন সকল মানুষের প্রাণ রক্ষা করলো।(সুরা মায়েদা, আয়াতঃ৩২)
তখন হযরত আবু হোরায়রা (রা) এই উক্তি শ্রবণ করে সঙ্গে সঙ্গে ফিরে আসলেন।

4 comments:

Powered by Blogger.