Header Ads

আগামীকাল নতুন সুর্য উঠবে। নতুন দিন শুরু হবে। নতুন একটি পৃথিবীর যাত্রা শুরু হবে। সেই পৃথিবীটা শুধু আল-কোরআনের। এই সপ্ন প্রত্যহই দেখি। শুধু বান্তবায়ন সময়ের অপেক্ষা............

হযরত ওসমান (রাঃ) এর শাহাদাত ও শাহাদাতের ফলাফল



আল্লাহর রসূল (সা) হযরত ওসমান (রা) সম্পর্কে যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, সাধারণ মুসলমানগণ বিদ্রোহীদের ধ্বংসাত্মক অভিযানে মধ্যে অশ্রু নয়নে তাই দেখতেছিলেন। একমাত্র হযরত ওসমানই নির্বিকার চিত্তে আল্লাহর রাসূলের অন্তিম বাণীর বাস্তবতা অবলোকন করার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। জুমার দিন সুর্যোদয়ের পূর্বেই তিনি রোজার নিয়ত করলেন। এই দিন তিনি সকালের দিকে স্বপ্ন দেখলেন, আল্লাহর রাসূল (সা) হযরত আবু বকর সিদ্দিক ও হযরত ওমর সমভিব্যহারে তাশরীফ এনে বলতেছেন- ওসমান (রা) শীঘ্র চলে আস। আমি এখানে তোমার ইফতারের অপেক্ষায় বসে আছি। চক্ষু খোলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বিবিকে ডেকে বললেন, আমার শাহাদাতের সময় নিকটবর্তী হয়েছে। বিদ্রোহীরা এখনই আমাকে হত্যা করে ফেলবে। বিবি বলিলেন,- না, না, এইরূপ কিছুতেই হতে পারে না। তিনি বলিলেন, আমি এখনই স্বপ্নে দেখেছিএই কথার পর বিছানা হতে উঠে একটি নূতন পাজামা পরিধান করলেন এবং কোরআন সম্মুখে নিয়ে তেলাওয়াতে বসে গেলেন।
ঐদিকে সেই সময় মোহাম্মদ ইবনে আবু বকর তীর নিক্ষেপ করতে শুরু করলেন। একটি তীর এসে খলিফার দ্বারে দণ্ডায়মান হযরত হোসাইনের শরীরে বিদ্ধ হল। হযরত হোসাইন (রা) গুরুতররূপে আহত হলেন। আর একটি তীর গৃহের অভ্যন্তরে মারওয়ানের শরীরে গিয়ে লাগল। হযরত আলীর গোলাম কাম্বরও মাথায় আঘাত প্রাপ্ত হনহযরত হোসাইনকে আহত হতে দেখে মোহাম্মদ ইবনে আবু বকর ভীত হয়ে উঠেনতিনি স্বীয় দুই সঙ্গীকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলেন- বনী হাশেম যদি হযরত হোসাইনের আহত হওয়ার খবর পায়, তবে আমাদের সমগ্র পরিকল্পনা বানচাল হয়ে যাবে। তারা হযরত ওসমানের কথা ভুলে হযরত হোসাইনের রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণ না করে ছাড়বে না। সুতরাং এই মুহূর্তে কার্য উদ্ধার করে ফেলা উচিত। মোহাম্মদ ইবনে আবু বকরের এই পরামর্শ মত সঙ্গে সঙ্গেই কয়েকজন বিদ্রোহী দেওয়াল টপকিয়ে গৃহের অভ্যন্তরে প্রবেশ করল। ঘটনাচক্রে খলিফার ঘরে তখন যে কয়জন মুসলমান উপস্থিত ছিলেন, সকলেই উপরে বসে অপেক্ষারত ছিলেন। হযরত ওসমান (রা) তখন একাকী নীচে বসে কোরআন তেলাওয়া্তে মশগুল ছিলেন। বিদ্রোহীদের সাথে গৃহে প্রবেশ করতঃ মোহাম্মদ ইবনে আবু বকর অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যবহার করলেন। তিনি হযরত ওসমানের পবিত্র দাড়ি আকর্ষণ করিয়া তাকে সজোরে মাটিতে ফেলে দিলেন। আমীরুল মোমেনীন ওসমান (রা) তখন বলতে লাগলেন- ভ্রাতুষ্পুত্র, আজ হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা) জীবিত থাকলে এই দৃশ্য কিছুতেই পছন্দ করতেন না। এই কথা শুনে মোহাম্মদ ইবনে আবু বকর অত্যন্ত লজ্জিত হয়ে পিচু হটে গেলেন, কিন্তু কেননা ইবনে বেশর একটি লোহার শলাকা দিয়া খলিফার মস্তকদেশে এক নিদারুণ আঘাত হানল। আঘাতের সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর রসূলের এই সম্মানিত প্রতিভূ বিছানায় গড়িয়ে পড়লেন এবং বলতে লাগলেনঃ বিসমিল্লাহ, আল্লাহর উপর ভরসা করিতেছি। দ্বিতীয় আঘাত করল সাওদান ইবনে আমরান। দ্বিতীয় আঘাতে রক্তের ফোয়ারা বহিয়া চলল। আমর ইবনে হোমকের নিকট এই নৃশংসতা যথেষ্ট মনে হল না। হতভাগ্য নায়েবে রাসূলের বুকের উপর আরোহণ করতঃ খড়গ দ্বারা আঘাতের পর আঘাত করতে শুরু করল। এই সময় অন্য এক নির্দয় তরবারি দ্বারা আঘাত করল। এই আঘাতের সময় বিবি হযরত নায়েলা দৌড়িয়ে ওসমান (রাঃ) কে দরতে গেলে তার তিনটি আঙ্গুল কেটে মাটিতে পড়ে গেল। এই ধস্তাধস্তির মধ্যেই আমীরুল মোমেনীনের পবিত্র আত্মা জড়দেহ ছেড়ে অনস্ত শূন্যে মিলিয়ে গেল। ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন।
নৃশংসতার এই পাশবিক দৃশ্য কেবলমাত্র হযরত নায়েলা সচক্ষে দর্শন করলেন। তিনি হযরত ওসমানকে নিহত হতে দেখে ঘরের ছাদে আরোহণ করতঃ চিৎকার করিয়া বলতে লাগলেন, আমীরুল মোমেনীন শহীদ হয়ে গিয়েছেন। খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমীরুল মোমেনীনের বন্ধুরা ছুটে এসে দেখলেন, হযরত ওসমানের রক্তাক্ত দেহ বিছানায় পড়ে রয়েছে। এই খবর প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মদীনাবাসীগণ ঊর্ধ্বশ্বাসে খলিফার গৃহের দিকে ছুটে আসলেন, কিন্তু তখন সব শেষ হয়ে গিয়েছিল। হযরত আলী (রা) কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে হযরত হাসান ও হোসাইনকে শাসন করতে লাগলেন, কিন্তু সময় অতিবাহিত হয়ে গিয়েছেহযরত ওসমান (রা) রক্তের ফোয়ারায় ডুবে গৃহের অভ্যন্তরে পড়েছিলেন, কিন্তু তখনও অবরোধ ঠিকমত চলছিল। দীর্ঘ দুই দিন পর্যন্ত খলিফাতুল মুসলেমনীনের পবিত্র লাশ গোর-কাফন ব্যতীত গৃহে পড়ে থাকেতৃতীয় দিন কতিপয় ভাগ্যবান মুসলমান এই শহীদের রক্তাক্ত লাশ দাফন-কাফনের জন্য  এগিয়ে আসলেন। মাত্র সতের জন লোক জানাযার নামায পড়লেন। এইভাবে আল্লাহর কিতাবের সর্বশ্রেষ্ঠ সেবক, সুন্নতে রাসূলের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রেমিককে জান্নাতুল বাকীতে নিয়ে সমাহিত করা হয়
দুর্ঘটনার সময় ওসমান (রা) কোরআন তেলাওয়াত করতেছিলেন। তাঁহার সম্মুখে পবিত্র কোরআন খোলা অবস্থায় পড়েছিল। হযরত ওসমানের পবিত্র রক্ত কোরআন পাকের নিম্নলিখিত আয়াতখানা রঞ্জিত করে দিয়েছিলঃ
فسيقفيك الله - انه هو السميع العليمআল্লাহই তোমার জন্য যথেষ্ট। তিনি প্রাজ্ঞ. তিনি সব শোনেন।
জুমার দিন আছরের সময় তিনি শহীদ হলেন। হযরত জুবাইর ইবনে মোত্য়েম জানাযার নামায পড়ালেন। হযরত আলী (রা) দুই হাত ঊর্ধ্বে তুলে বলতে লাগলেন, আমি ওসমানের রক্তপাত হতে সম্পূর্ণ নির্দোষ! সায়ীদ ইবনে যায়েদ (রা) বললেন, তোমাদের ধৃষ্টতার প্রতিফলস্বরূপ ওহুদ পর্বত ফেটে পড়ার কথা। হযরত আনাস (রা) বললেন, হযরত ওসমানের জীবদ্দশা পর্যন্ত আল্লাহর তরবারি কোষবদ্ধ ছিল। তার শাহাদাতের পর অদ্য এই তরবারি কোষমুক্ত হবে এবং কেয়ামত পর্যন্ত উহা কোষমুক্তই থাকবে। হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, যদি হযরত ওসমানের রক্তের প্রতিশোধ দাবী করা না হত তবে মানুষের উপর আকাশ হতে প্রস্তর বর্ষিত হত হযরত সামুর (রা) বলেন, হযরত ওসমান(রাঃ)-হত্যার জের কেয়ামত পর্যন্ত বন্ধ হবে না এবং ইসলামী খেলাফত মদীনা হতে এমনভাবে বহিস্কৃত হবে, যা কেয়ামত পর্যন্ত আর কখনও মদীনায় ফিরে আসবে না।
কাব ইবনে মালেক (রা) শাহাদাতের খবর শুনলেন, সঙ্গে সঙ্গে তার মুখ হতে কয়েকটি কবিতা বের হয়ে আসল। যার মর্ম হল-
তিনি তার উভয় হস্ত বেধেঁ রাখলেন, গৃহের দরজাও বন্ধ করে দিলেন। মনে মনে বললেন, আল্লাহ সব কিছুই জানেন। তিনি তার সঙ্গীদিগকে বললেন, শত্রুদের সহিত যুদ্ধ করিও না। আজ যে ব্যক্তি আমার জন্য যুদ্ধ না করবে, সে আল্লাহর শান্তির ছায়ায় থাকিবে।
ওহে দর্শকগণ! হযরত ওসমানে শাহাদাতের ফলে পরস্পরের ভালবাসা কেমন করে নষ্ট হয়ে গেল। আর আল্লাহ তার জায়গায় পরস্পরের উপর শত্রুতার বোঝা চাপিয়ে দিলেন।
হায়! ওসমানের পর মঙ্গল এমনভাবে অন্তর্হিত হবে, যেমন তীব্র ঘূর্ণিবাত্যা এসে সঙ্গে সঙ্গে অনর্হিত হয়ে যায়।
ওসমান (রাঃ) হত্যার ফলাফলঃ
হযরত ওসমানের শাহাদাতের খবর মুহূর্তের মধ্যে সমগ্র মুসলিম জাহানে ছড়িয়ে পড়ল। এই সময় হযরত হোযাইফা (রা) বলেন, পরবর্তী সমস্ত ঘটনাই তাঁর সেই কথার ব্যাখ্যা প্রদান করেছে। তিনি বলেছিলেন, হযরত ওসমানের শাহাদাতের ফলে মুসলিম জাহানে এমন এক বিপর্যয় নেমে এসেছে, কেয়ামত পর্যন্তহ যা রুদ্ধ হওয়ার নহে।
হযরত ওসমানের রক্তাক্ত জামা ও হযরত নায়েলার কাটা আঙ্গুলি বনী উমাইয়ার তদানীন্তন বিশিষ্ট নেতা, সিরিয়ার শাসনকর্তা হযরত আমির মোয়াবিয়ার নিকট পাঠিয়ে দেওয়া হল। খলিফাতুল মুসলেমীনের এই রক্তাক্ত জামা যখন সিরিয়ায় গভর্নর হাউজে খোলা হয়, তখন চারিদিক হইতে কেবল প্রতিশোধ প্রতিশোধ আওয়াজ উঠল। বনী উমাইয়ার বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ সকলে আমির মোয়াবিয়ার নিকট সমবেত হলেন। এখানে এ কথা বিশেষভাবে উল্লেখ্যযোগ্য, হযরত আলীর খেলাফত হতে শুরু করে ইমাম হোসাইনের শাহাদাত এবং আমির মোয়াবিয়ার পর উমাইয়া ও আব্বাসিয়া খেলাফতের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত যতগুলি দুর্ঘটনার সৃষ্টি হয়েছে, প্রত্যেকটি স্থানেই হযরত ওসমানের পবিত্র রক্ত ক্রিয়াশীল দেখতে পাওয়া যায়। হযরত ওসমানের এই শাহাদাত এমন একটি দুর্ঘটনা, যদ্দ্বারা ইসলামের ভাগ্যই পরিবর্তিত হয়ে গেল। জঙ্গে জামালে যাহা কিছু হইয়াছে, তাহাও এই রক্তের জের মাত্র।সিফফিনে যাহা হয়েছে তা এই ঘটনারই ফল। তৎপর কারবালাতে যাহা কিছু অনুষ্ঠিত হইয়েছে তাও এই ঘটনারই দুঃখজন পরিণতি। তৎপর উমাইয়া বনাম আব্বাসিয়া প্রশ্নে যে সমস্ত দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে, তাও এই বিভ্রান্তি বা বেদনাদায়ক অপকর্মেরই স্বাভাবিক পরিণতি মাত্র। হযরত ওসমানের শাহাদাতের পর বনী উমাইয়া ও বনী হাশেমের গোত্রীয় বিদ্বেষের আগুন আবার নূতনভাবে জ্বলে উঠল এবং ইসলামের যে বিদ্যুতসম শক্তি একদা সমগ্র দুনিয়ার শান্তির সমৃদ্ধির শপথ নিয়ে অগ্রসর হয়েছিল, তাহা এমনভাবে বিপর্যস্ত হল যে, অতঃপর আর কখনও সেই বিপর্যয় সামলিয়ে উঠা সম্ভবপর হয়নি।

No comments

Powered by Blogger.