কাবার পানে কাফেলা
কাবার পানে কাফেলা
বেলাল আল জাবের
রুদ্ধশ্বাসে
এগিয়ে চলছে কাফেলা । শরীর ঘর্মাক্ত, সূর্যের আলোতে চিকমিক করা ললাট ।
ক্লান্ত,শ্রান্ত দেহে মিলিয়ে আসছে নেত্র যুগল । এ কিসের আশায়? কিসের নেশায়? গভীর
আকর্ষনে একের পর এক সামনে এগিয়ে চলা । মুহর্ত পূর্বেই মনের আকাশে শূভ্রতার এক পশরা
বৃষ্টি মুছে দিয়েছে পাপের সকল কালিমাগুলো, ঘুচিয়ে দিয়েছে সকল জরা, পুতঃপবিত্র
করেছে অন্তর। এখন আর চোখ ধাঁধানো ঝলসে দেয়া পৃথিবীর কোন চাকচিক্য, ভালবাসা আর
ভাললাগার কোন রক্ষিত বাঁধন এই এগিয়ে চলায় প্রতিবন্ধক নয়। প্রশান্ত আত্মার অপলক
দৃষ্টি শুধু ঐ স্বর্ণ খচিত কালোগিলাপে ঢাকা চতুর্কোন বিশিষ্ট ঘনক্ষেত্রের বিশেষ
ঘরের দিকে। অবিরাম এগিয়ে চলা সাদা মর্মর পাথরের উপর। মুখে চমৎকার ধ্বনি- বান্দা হাজির
তোমার পবিত্র ঘরে হয়েছি হাজির সকল প্রশংসা সকল নিয়ামত সকল বাদশাহি কেবল তোমারি তরে
নাই কোন শরীক আল্লাহ তোমার সাথে। বান্দা হাজির। প্রতি বছর মুস্লিম মিল্লাতকে
এভাবেই তাদের প্রানের কাবা তদেরকে হজ্জের মিলন কেন্দ্রে মিলিত করে। আল্লাহর আদেশ
যে এটাই। এরশাদ হচ্ছে- “এবং মানুষের নিকট হজ্জের ঘোষনা করে দাও, তারা তোমার নিকট
আসবে পায়ে হেটে এবং সব ধরনের ক্ষীনকায় উটের উপর আরোহন করে, এরা আসবে দূর-দূরান্তের
পথ অতিক্রম করে”(সূরা হাজ্জ, আয়াতঃ ২৭ )। অন্যত্র এরশাদ হচ্ছেম -
“মানুষের মধ্য যার সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে, আল্লাহর উদ্দেশ্যে ঐ ঘরের হজ্জ করা
তার অবশ্য কর্তব্য এবং কেউ প্রত্যাখ্যান করলে সে জেনে রাখুক, আল্লাহ বিশ্বজগতের
মুখাপাক্ষী নন”(সূরা আলে ইমরান, আয়াত-৯৭)। আলচ্য আয়াত দ্ধয় থেকে একটি বিষয়েই আহবান
করা হয়েছে তা হল, হজ্জ হবে একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট। হজ্জের জন্য এ তীর্থ
যাত্রায় গমন কারীর হ্নদয় রাজ্যের প্রতিটি কুঠুরিতে একটিই আরাধনা তা হল হে আমার রব আমি
তোমার ডাকে তোমার কাছে হাজির। এ দুনিয়ার কোন বালাখানা, জীবন জৌলুস,
কামিনী, মহিনী, হরিনীর লালসায় নয়। পৃথিবীর কোন রাজা-বাদশাহ কিংবা তার বানানো কোন
ঘরের মোহে নয়। আমিতো উদাশিনী হয়েছি রাজাধিরাজ অসীম ক্ষমতা আর নিয়ামতের মালিক
প্রশংসার অতীত মহান রবের প্রেম সমুদ্রে সাতাঁর দিতে। শুধু তার ডাকে। এখানে প্রশ্ন
দাড়ায় তাহলে আমরা কি আমাদের পালনকৃত হজ্জ কে আল্লাহর জন্য নির্ধারন করতে পেরেছি। দুনিয়াবী
সকল মোহ ও লৌকিকতা কতটুকু ত্যাগ করতে পেরেছি। ক্ষেত্র
বিশেষে এদেশের মানুষ যেখানে হজ্জ পালন করে নির্বাচনে নিজের ভোট ব্যাংক ভারি করার জন্য। নামের
পুর্বে অতিরিক্ত টাইটেল “আলহাজ্জ” যুক্ত করার জন্য। সামাজিক
মর্যাদা বৃদ্ধি, পারিবারিক কৌলিন্য প্রকাশ, ব্যক্তিগত ষ্ট্যাটাস ইত্যাদি হাজারো লোভনীয় উদ্দেশ্যতো রয়েছেই। অন্যদিকে
আমাদের সম্মানিত আলেম, উলামা ও খতিব সাহেবরা তো আরো একটু এগিয়ে। “আলহাজ্জ” টাইটেলের সাথে তাদের দাওয়াত,ওয়াজ-মাহফিল ও বিভিন্ন আয়ের পথ জড়িত। সাধারন
জনগনের পকেট খসানোর লক্ষ্যে হজ্জ এর মুল উদ্দেশ্য প্রচারের পরিবর্তে নবিজি সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর একটি বানী বারংবার আওড়াতে দেখা যায়। তা
হল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-“ আলহাজ্জুল মাবরুরু লাইছা লাহুল যাযা ইল্লাল জান্নাত”(বুখারী ও মুসলিম)। কবুল হজ্জের পুরস্কার হল জান্নাত। তারা
সাথে বিভিন্ন উদাহরন ও গাল-গল্প উপস্থাপনের মাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে প্রমান
করার চেষ্টা করেন যে, হজ্জ কেবল মাত্র তাদেরি কবুল হয়। কারন
বাহ্যত তারা নবিজীর ওয়ারিশ আলেম। সুতরাং বদলি হজ্জ করানো, ইছালে ছওয়াব করে
জান্নাতের বুকিং দিতে তাদের প্রয়োজন। বলাবাহুল্য
যে যত বেশী উপরী(তাদের ভাষায় হাদিয়া) দিতে
পারবেন তার জন্য তত বড় জান্নাতের উচুঁ স্তর বুকিং দিবেন। কত
বড় পরিতাপের বিষয় আজ আমরা ইসলাম প্রচারে কুট কৌশল ও হাদিয়ার উপর নির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছি। অথচ
নামাজের জন্য যেমন ওযু এবং পবিত্রতা অপরিহার্য। তেমনি
হজ্জের ক্ষেত্রে কুট কৌশল, লৌকিকতা, লোভ-লালসা পরিহার করে তা আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করাও অপরিহার্য।
কাবার পথে-https://balalislamicmedia.blogspot.com/ |
কাবা স্পর্শ করে যদি কেউ দেবমূর্তির কথা স্বরন করে তাহলে কি
সে আল্লাহর একত্ববাদের মহিমা উন্মোচন করতে পারবে? যদি কেউ ফুলের
মধ্য কাটা আহরনে আগ্রহী হয় তাহলে কিছুতেই সে ফুলের সুবাস ও সৌরভ লাভের অধিকারী হতে
পারেনা। বিকৃত মানসিকতার কারনে চিকিৎসাকে রোগ বিবেচনা করলে
বাস্তবিকই তা চিকিৎসার অতীত। হযরত ইব্রাহীম আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু কোবায়স পাহাড়
মতান্তরে মাকামে ইব্রাহীমে দাড়িয়ে এই ঘোষনাটিই দিয়েছিলেন। তিনি স্বীয় কানের মধ্যে
আঙ্গুল ডুকিয়ে চতুর্দিকে মুখ ফিরিয়ে এ বলে আহবান করেন- “তোমাদের রব একটি ঘর
নির্মান করেছেন, তিনি তোমাদের উপর তার সন্তুষ্টির লক্ষ্যে এর হজ্জ ফরয করেছেন।
অতএব তোমরা তোমাদের রবের আহবানে সাড়া দাও”। হজ্জের জন্য ইহরাম বাধা, আরাফাত ময়দানে
অবস্থান করা, কাবা শরীফ যেয়ারত করা সহ যাবতীয় কর্ম গুলু একটি আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।
হজ্জের মুল উদ্দেশ্যই হল বান্দা তার রবের সামনে দাসত্বের চুড়ান্ত প্রমান দিয়ে মহান
মালিকের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। মহান আল্লাহ সুবহানাহু
বলেন- “আতিম্মুল হাজ্জা ওয়াল উমরাতা লিল্লাহি”(সূরা বাকারাহ, আয়াতঃ ১৯৬ আংশিক)।
তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ্জ, উমরাহ পূর্ন কর। লক্ষ্যনীয় যে পবিত্র মাহে রমজানের সাথে হজ্জের একটি
গভীরতম নীবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান। বান্দা রোজায় মুকিম অবস্থায় ক্ষুধার যন্ত্রনা ভোগ,
পাপ মুক্ত জীবন প্রতিপালন, ধৈর্য-সহিষ্ণুতা ও আত্মসংযমের চরম পরীক্ষায় উত্তীর্ন
হওয়ার পরের মাস গুলোতেই নিজ গৃহ ত্যাগ করে ক্লেশ, স্বজনহীন অবস্থায় বিবিধ অজানা,
অদেখা, অপ্রত্যাশিত অবন্থা, পরিবেশ ও পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। এমতাবস্থায়
একমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা ও আত্মসংযমের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শ্ন করা ছাড়া কোন
গতন্তরই থাকেনা। এভাবেই হজ্জ বান্দার আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধন করে পরহেজগারীর
অভিষ্ঠ লক্ষে পৌছিঁয়ে তাকে পুনর্জন্ম দান করে। পবিত্র কুরানুল কারীমের ভাষ্য- “হজ্জ
হয় সুবিদিত মাসে( শাওয়াল, জিলকদ, যুলহাজ্জ)। অতঃপর যে কেউ এ মাস গুলোতে হজ্জ করার
সিদ্ধান্ত নেয়, তার জন্য হজ্জের সময়ে স্ত্রী সম্ভোগ, আন্যায় আচরন ও কলহ বিবাদ নয়।
তোমরা যা কিছু উত্তম কাজ মনে কর আল্লাহ সে সম্পর্কে অবগত। আর তোমরা পাথেয় ব্যবস্থা
কর, তবে আত্মসংযমই শ্রেষ্ঠ পাথেয়। হে বোধ সম্পর্ন ব্যক্তিগন তোমরা আমাকে ভয়
কর”(সূরা বাকারাহ, আয়াতঃ ১৯৭)। এক্ষনে
স্পষ্ট হল যে, একজন ব্যক্তি রোজা পালন ও তার পরবর্তী হজ্জ আদায়ে হয়ে উঠেন পরহেজগার
ও আত্মসংযমী হিসেবে। অন্য দিকে হজ্জের মুল আহবানের দিকে ইংগিত করে মহান আল্লাহ
এরশাদ করেন- “ মানব জাতির জন্য সর্বপ্রথম যে গৃহ প্রতিষ্ঠিত হয় তাতো বাক্কায়(
মক্কার অপর নাম) ইহা বরকতময় ও বিশ্বজগতের দিশারী। এতে অনেক সুষ্পষ্ট নিদর্শন আছে,
(যেমন) মাকামে ইব্রাহীম। এবং যে কেউ সেখানে প্রবেশ করবে সে নিরাপধ”(সূরা আল ইমরান,
আয়াতঃ ৯৬)। আয়াতে কারীমার বর্ননা ভংগিতে ষ্পষ্ট হজ্জ ও পবিত্র প্রানের কাবা শরীফের
মুল আহবান হল মানুষের নিরাপত্তা বিধান করা। বলাই হচ্ছে- “যে কেউ সেখানে প্রবেশ
করবে সে নিরাপধ” । সুতঃরাং এর যিয়ারত কারী আল্লাহর মেহমানদের কর্তব্য তো একটাই হবে
সারা বিশ্বময় শান্তি, নিরাপত্তা, সংকাহীন জীবন যাপনের ব্যবস্থা করা। বিশেষতঃ
মুসলিম দেশ, জাতি ও নাগরিকে নিরাপত্তা বিধানের লক্ষে নিরলস কাজ করে যাওয়া।
উল্লেক্ষ্য যে সৌদি আরবের পরিসংখ্যান অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে ২০১৬ খ্রি.(১৪৩৭ হিজরি) সনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও তাদের অভ্যন্তরীন
মোট হাজীর সংখ্যা ছিল ১৮,৬২,৯০৯(
আঠার লক্ষ বাষট্রি হাজার নয় শত নয়) জন। যেখানে
বাংলাদেশী হাজীর সংখ্যা প্রায় লক্ষাদিক (তথ্য সূত্র, ইন্টারনেট)। ২০১৫
সালে এই সংখ্যা ছিল প্রায় ২০,০০,০০(বিশ লক্ষ)। আশা করা যায় এ বছর ২০১৭ সালেও এর সংখ্যা কাছাকাছিই থাকবে। এখানেই
প্রশ্ন প্রত্যেক বছরান্তে হজ্জ সমাপনান্তে এত বিশাল সংখ্যক আত্মসংযমী শান্তিকামী নিরাপত্তা
কর্মী প্রানের কাবা শরীফ থেকে বের হলেও পৃথিবীতে শান্তি আর নিরাপত্তা ফিরছেনা কেন? আজ সারা বিশ্ব সন্ত্রাসবাদের ভয়ংকর আতংকে ভুগছে। ফিলিস্তিনে
আমাদের শান্তিকামী, স্বাধীনতাকামী মুসলিম ভাইরা ইহুদীদের সন্ত্রাসী
আক্রমন থেকে নিরাপদ নয়। নিকট অতীতে শতাব্দীর বৃহৎ মানবতা বিরোধী সন্ত্রাসী নির্যাতন
মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে মুসলমানদের করা হল। খোদ
আরব বিশ্বই এখন সন্ত্রাসবাদের হিংস্র থাবায় নিপতিত। এদিকে
আমরাও আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে
শান্তিতে নেই। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় কিছু নামধারী মুসলমান স্ত্রাস করছে। বাংলাদেশের
নিকট অতীতের হামলা গুলুতে তাই দেখেছি আমরা। এ গুলো কেন দেখতে হবে আমাদের? তা হলে আল্লাহর বানী কি সত্য নয়(নাউযু বিল্লাহ)? নতুবা আমাদের আনুগত্য, ইবাদত বিষেশত হজ্জ পালনে কোন ত্রুটি
থেকে যাচ্ছে। আসলে
আজ আমরা পবিত্র কাবা শরীফের মুল আবেদন থেকে বিচ্ছুত। অথচ
আল্লাহ তায়ালা এ ঘরটিকে বরকতময়, নিরাপত্তার প্রতীক ও বিশ্বজগতের দিশারী বলেছেন। এ
বিশ্বজগতের দিশারী আমাদের যে পথ বাতলে দিচ্ছে আমরা তা পালন করছিনা। যুগে
যুগে যত নবী ও রাসূল পৃথিবীতে অবতীর্ন হয়েছেন
তারা প্রত্যেকেই এ ঘরকে তাওয়াফ করে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিয়েছেন শান্তির বানী। শান্তি
ও নিরাপত্তার মহান দূত সরদারে দুজাহান হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
বিদায় হজ্জ সমাপনান্তে আরাফাত ময়দানে জীবনের শেষ ভাষনে বললেন- “হে জনমন্ডলী! আজকের এই দিন(জুমার
দিন) এই মাস ( জিলহজ্জ মাস) ও এই শহর(মক্কা শরীফ) যেমন পবিত্র;
তোমাদের জান-মাল, ইজ্জত-আবরু, মান-সম্মান কিয়ামত পর্যন্ত এমনই পবিত্র। তোমরা
পরস্পর খুনা খুনি করনা। আমি তোমাদের মাঝে এমন দুটি জিনিস রেখে গেলাম, তোমরা তা দৃড়
ভাবে আকড়ে ধরলে কখনো বিভ্রান্ত হবেনা। তা হচ্ছে আল্লাহর কিতাব(পবিত্র কোরান) ও তার
রাসুলের হাদীস”(সহিহ মুসলিম, তিরমিযি)। সর্বপরী বলতে হয়, হজ্জ যেমন বান্দাকে
পবিত্র, পরহেজগার ও আত্মসংযমী করে তুলে পাশাপাশি আমাদের কর্তব্য হল তা একমাত্র
আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করা এবং হজ্জ পালন শেষে সমগ্র বিশ্বের নিরাপত্তায় নিজেকে
নিয়োযিত করার সাথে বিশ্ব মুসলিমের কল্যান,ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব, সহমর্মিতা, পারস্পরিক
সহযোগিতা ও নিজ দেশের শান্তি-নিরাপত্তা রক্ষায় নিজেকে নিয়োজিত করার দৃড় প্রতিজ্ঞা
করা। তবেইতো মহান মালিকের ইচ্ছার পরিপুর্ন প্রতিফলন ঘটবে।
No comments